‘অখণ্ড ভারতে’র ম্যুরাল: বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রতিক্রিয়া
2023.06.05
কলকাতা ও ঢাকা
ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরে ও বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৮ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। সেখানে স্থাপিত একটি ম্যুরালে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভৌগলিক এলাকাকে ‘অখণ্ড ভারত’ নামের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভারতের সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি টুইট করে বলেন, “সংকল্পটা স্পষ্ট—অখণ্ড ভারত।”
এই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের এই উদ্যোগের সমালোচনা করেছে। তবে বাংলাদেশ ও নেপাল এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
বাংলাদেশে নানামুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সোমবার সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম জানান, ভারতের সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’ মানচিত্রে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশকে দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা জানার জন্য দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“এটি (অখণ্ড ভারত) নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কোনো কারণ নেই। তারপরও বাড়তি ব্যাখ্যার জন্য আমরা দিল্লির মিশনকে বলেছি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলতে, তাদের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা কী তা জানার জন্য,” বলেন শাহরিয়ার।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন যে এটি অশোকা সাম্রাজ্যের মানচিত্র যা খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগের। সেই সময়ের যে অঞ্চলটি ছিল, তার একটি মানচিত্র এবং এটি একটি ম্যুরাল। ওই ম্যুরালে চিত্রায়ন করা হয়েছে মানুষের যাত্রা। এখানে সাংস্কৃতিক মিল থাকতে পারে কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।”
বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় প্রতিবাদ না জানানো দুঃখজনক। ভারতের এই উদ্যোগ আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর এবং সরাসরি হস্তক্ষেপ।”
‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্রে বাংলাদেশকে অঙ্গীভূত করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
ভারত সরকার কর্তৃক স্থাপিত এই ম্যুরাল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ মন্তব্য করে সিপিবি’র বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারকে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে হবে।
আলাদা বিবৃতিতে, এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
“ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত মানচিত্র প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। এই অপতৎপরতা ভারতের আধিপত্যবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ,” বিবৃতিতে বলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “ভারত এই কাজটি মোটেও ভালো করেনি। এটা বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর।”
বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডকে কল্পিত ‘অখণ্ড ভারত’ এর অংশ দেখিয়ে ভারতীয় নতুন পার্লামেন্ট ভবনে মানচিত্রের ম্যুরাল স্থাপনের প্রতিবাদে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল।
আনুষ্ঠানিকভাবে নেপাল এখনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই এক বিবৃতিতে ভারতের এই উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি করবে। এর ফলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে তাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।”
আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান।
ম্যুরাল স্থাপনের ঘটনায় চলমান বিতর্কের মুখে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বেগ নিরসনে বলেছেন, “ম্যুরালটিতে অশোকের সাম্রাজ্য এবং তিনি দায়বদ্ধতা ও জনগণের জন্য শাসকের যে ভাবধারা গ্রহণ ও প্রচার করেছিলেন তাই তুলে ধরা হয়েছে।”
অখণ্ড ভারতের ধারণা
ভারতের হিন্দুবাদী শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির মতাদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মধ্যে অখণ্ড ভারতের ধারণা বহু দিন ধরেই বিদ্যমান। আরএসএস মনে করে, অখণ্ড ভারত হলো প্রাচীন সাংস্কৃতিক ভারতবর্ষ। প্রাচীনকালে যেসব এলাকায় ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল, তা নিয়েই অখণ্ড ভারত।
আরএসএস তাত্ত্বিকদের ধারণা, অখণ্ড ভারত কোনো অবাস্তব কল্পনা নয়।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও আরএসএসের মধ্যে সমন্বয় রক্ষাকারী দলের সাধারণ সম্পাদক রামমাধব বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, “ঐতিহাসিক কারণে যে ভূ-খণ্ডগুলো আলাদা হয়েছিল, মানুষের ইচ্ছাতেই তা আবার এক হতে পারে বলে মনে করে আরএসএস।”
অবশ্য তিনি এ-ও বলেছেন, “তার মানে এই নয় যে আমরা কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব বা দখল করে নেব।”
বিজেপি’র ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ বেনারকে বলেন, “একেবারে প্রাচীন যুগ থেকে মহান ভারতীয় সভ্যতা আফগানিস্তান থেকে একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অংশে বিস্তৃত ছিল। অখণ্ড ভারত তারই প্রতিচ্ছবি।”
সংসদ ভবনে যে কারণে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র
সংসদে যে ম্যুরালটি স্থাপন করা হয়েছে তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে অধ্যাপক নন্দ বলেন, “এটি এমন একটি ম্যুরাল যেখানে মহান ভারতীয় সভ্যতার প্রভাবকে তুলে ধরা হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতার প্রাণ শক্তিকে বর্ণনা করা হয়েছে।”
তিনি মনে করেন, “এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক মানে খোঁজার প্রয়োজন নেই। বরং এটাই সত্যি যে, ভারত এমন একটি পুরানো সভ্যতা যার সঙ্গে বাংলাদেশ বা নেপালের মতো দেশ আত্মীয়তা পোষণ করতে পারে এটা সেই সভ্যতারই প্রতিচ্ছবি মাত্র।”
অখণ্ড ভারতের মানচিত্রকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “এইভাবে জোর করে ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়া ভারতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।”
তিনি আরও বলেন, “অখণ্ড ভারতের মানচিত্র দিয়ে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ শাসক দলের কল্যাণে অকারণে দেশের পরিস্থিতি অস্থির করে তুলবে। সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হবে।”
তার ভাষ্য, এর পেছনে বড়ো রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ।
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের ম্যুরাল স্থাপন অনাবশ্যক। অবশ্য এর মাধ্যমে স্বার্থ বুদ্ধি এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের অঙ্ক মাথায় রেখে যদি এসব করা হয় তাহলে তা সমীচীন হয় না।”
ভারতীয় সমাজকর্মী রোহিত স্যানাল বেনারকে বলেন, “আরএসএসের আদর্শপুষ্ট শাসক দলের নেতারা যেভাবে অখণ্ড ভারতের ধারণাকে নানাভাবে তুলে ধরছেন তাতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে।”
“বিভেদ ও বিদ্বেষের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে শাসক দল এগিয়ে গেলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে অবিশ্বাসের বাতাবরণ আরও বৃদ্ধি পাবে,” মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “এই ধরনের মনোভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদী শক্তিকেই উসকানি দেবে। বরং ভারতের উচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিরোধের সমাধান করে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া গঠনে তৎপর হওয়া।”