সীমান্ত হত্যা শূন্য করার ঘোষণা দেওয়ার দিনই বিএসএফের গুলিতে কিশোর নিহত

কামরান রেজা চৌধুরী ও পরিতোষ পাল
2022.09.08
ঢাকা ও কলকাতা
সীমান্ত হত্যা শূন্য করার ঘোষণা দেওয়ার দিনই বিএসএফের গুলিতে কিশোর নিহত দিনাজপুরের ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি উৎসুক জনতার ভিড়। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বুধবার রাতে দিনাজপুর সীমান্তে এক বাংলাদেশি কিশোরকে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী-বিএসএফ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থানের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটল, যা দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ভুল বার্তা দেয় বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

নিহত বাংলাদেশির নাম মিনহাজুল ইসলাম মিলন (১৭)। মিলন দিনাজপুর সদর উপজেলার আসকারপুর ইউনিয়নের ভিতরপারা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিলন দাইনুর সীমান্তে ৩১৫ নম্বর পিলারের কাছে ভারতীয় অংশে নিহত হয়। গ্রামবাসীরা সকালে তাঁর লাশ পড়ে থাকতে দেখে পরিবারে খবর দেয়।

বাবা জাহাঙ্গীর বেনারকে জানান, মিলন স্থানীয় স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। সে রাত নয়টার পর কয়েকজনের সাথে সীমান্ত এলাকায় শুটকি মাছ নিতে যায়।

বাড়ি ফিরে না আসায় ফোন দিলে দেখি ফোন বন্ধ। সকালে সবাই এসে খবর দেয় যে সে মরে পড়ে আছে,” বলেন জাহাঙ্গীর।

স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাত ১১টার দিকে তাঁরা কয়েকটি গুলির শব্দ শুনেছেন।

নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার অধিকার নেই’

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফ এর হাতে ‘একতরফা হত্যাকাণ্ড’ ঘটেই চলেছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের যৌথ ইশতেহারেও গতকাল বলা হয়েছে যে, সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার যে কথা ভারতের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয় সেটি প্রকৃতপক্ষে কাগুজে কথা।”

তিনি বলেন, “প্রতিটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার জোর দাবি জানানো হলেও সেটি বন্ধ হয় না। ভারত আমাদের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না।”

নূর খানের মতে, বেআইনিভাবে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করলে তাঁকে আইনের আওতায় আনার সকল অধিকার বিএসএফ এর রয়েছে। কিন্তু “একজন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা করার অধিকার বিএসএফ এর নেই।”

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এর হিসাবে ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ- এর হাতে এক হাজার ২৫৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিএসএফ’র গুলিতে ছয়জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন সাতজন এবং আহত হয়েছেন চারজন।

প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে, যেটি অনেক স্থানেই অরক্ষিত। চোরাকারবারিরা বিভিন্ন সময় অবৈধ কাজে সীমান্তে চলাচল করে।

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সীমান্ত হত্যা অন্যতম বড়ো সমস্যা। ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হয়, যে সীমান্তে নিহত বাংলাদেশিরা চোরাকারবারের সাথে সংশ্লিষ্ট।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন,  “এই হত্যাকাণ্ড আমাদের এই ধারণা দেয় যে, ভারত আমাদের সাথে ভালো প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করছে না, যদিও বাংলাদেশ ভারতের সাথে অত্যন্ত সুন্দর প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে থাকে।”

প্রকৃতপক্ষে এটি হত্যাকাণ্ড এবং এ ধরনের কাজ আন্তর্জাতিক আইন বিরুদ্ধ,” জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ “নিরস্ত্র কোনো মানুষকে হত্যার অধিকার” বিএসএফ এর নেই।

এ প্রসঙ্গে মন্তব্যের জন্য বেনারের পক্ষ থেকে বিএসএফের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের আইজি অজয় সিংয়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে বহুবার দুই দেশের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা হলেও “সীমান্ত হত্যা বন্ধ তো হয়ই নি, বরং বেড়ে চলেছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বেসরকারি সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায়।

শুধু হত্যাই নয়, নির্যাতন, গুম, ধর্ষণ ও অকারণে গরিব সীমান্তবাসীদের হয়রানি করছে বিএসএফ,” বলেন কিরীটি রায়।

তিনি আরও বলেন, “নেপাল ও ভুটান সীমান্তে হত্যার ঘটনা ঘটছে না। অথচ ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বলা হলেও বাংলাদেশ সীমান্তে এটা ঘটছে। এমনকি মারণাস্ত্র প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও তা নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।