দুই প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল সম্মেলন: আবারো ভারতের কাছে তিস্তার পানি বণ্টন প্রসঙ্গ উত্থাপন করল বাংলাদেশ
2020.12.17
ঢাকা
দীর্ঘ দিন থেকে আটকে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য আবারো ভারতকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার দুই নেতার প্রথম ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এই অনুরোধ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ছাড়াও এই সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা ও সুরক্ষা, আঞ্চলিক সড়ক আন্তঃসংযোগ সম্পর্কে আলোচনা হয়।
পাশাপাশি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া দুই দেশের মধ্যকার চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল সংযোগটি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে উভয় সরকারের সম্মতি অনুসারে তিস্তার পানিবণ্টনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাতে ভারতের সরকারের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এবং অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন,” বলা হয় সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে।
তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ভারত “সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য আলোচনা” করার কথা জানিয়েছে বলে সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
এ বিষয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, “এই চুক্তির বিষয়ে আমরাও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দিক থেকে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন। ভারতের দিক থেকে প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”
এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন ছয় নদী; মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি চূড়ান্ত করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন বলে দুই দেশের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়।
ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে আগ্রহী বাংলাদেশ
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি বাড়াতে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বলে সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
তিনি বলেন, “থাইল্যান্ড-মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে। আজকের বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সড়কে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সড়কে যুক্ত হওয়া গেলে আমরা লাভবান হব।”
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “ভারত সবসময়ই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার প্রদান করে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার এই নীতি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমার অগ্রাধিকারে রয়েছে।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন।
চলতি বছরের মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবাষির্কীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় সে সফর আর হয়নি।
পরবর্তীতে অনুষ্ঠান উদ্বোধনী উপলক্ষে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া গত মার্চে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সার্ক নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সেও অংশগ্রহণ করেন ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে আগামী বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন বলে জানানো হয় সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে।
“আগামী বছর বাংলাদেশ সফরে বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাওয়া আমার জন্য সম্মানজনক,” বলেন নরেন্দ্র মোদি, জানায় সরকারি বার্তাসংস্থা বাসস।
বাসস আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতিকে আরও সংহত করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন সম্মেলনে।
‘সীমান্ত হত্যা সম্পর্কের কলঙ্ক’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানান, ভার্চুয়াল সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে থেকে উপস্থাপন করা হলে তা শূন্যে নামিয়ে আনতে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বিষয়টি বহুবার উত্থাপন করা হলেও কার্যত তা বন্ধ হয়নি জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত হত্যাকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের কলঙ্ক বলে উল্লেখ করেন।
“দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত উষ্ণ, কিন্তু সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের মতো নেতিবাচক কিছু উপাদানের জন্য এটি কলঙ্কিত হচ্ছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য প্রধান সমস্যা সমাধান না হওয়া প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান সম্ভব।”
তিনি বলেন, “আজকেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন।”
“আমরা চাই না একজন লোকও সীমান্তে মারা যাক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ ধরনের ঘটনা সময়ে সময়ে হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এত সুন্দর সম্পর্ক। কিন্তু এগুলো সম্পর্কে কলঙ্ক তৈরি করে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত বছর সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ৪১ বাংলাদেশি।
সাতটি সমোঝতা স্বাক্ষর
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের মধ্যে সাতটি কাঠামো চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এগুলো হলো; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিইও ফোরাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাইড্রোকার্বন বিষয়ে সহযোগিতা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও ভারতের জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও বরিশালের স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি।
বাংলাদেশের পক্ষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা এবং ভারতের পক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী চুক্তিগুলোতে সই করেন।