লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশির মৃত্যু

শরীফ খিয়াম ও পরিতোষ পাল
2021.01.15
ঢাকা ও কলকাতা
লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশির মৃত্যু ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার একটি বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের টহল। ১৩ আগস্ট ২০১৮।
[এএফপি]

লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে শুক্রবার আবুল কালাম (৩০) নামের এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মোহন্ত বেনারকে বলেন, “ভোর রাতে আরো চার-পাঁচজনের সাথে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন আবুল কালাম। সেখানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সঙ্গীরা আহত অবস্থায় তাঁকে নিয়ে আসে।”

“হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা গেলে আমরা লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছি,” বলেন তিনি। 

নিহত আবুল কালাম পাটগ্রামের শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝালঙ্গী এলাকার মৃত জয়নাল হকের ছেলে। তাঁর বাড়ি ভারতীয় সীমান্তের একেবারে কাছে বলে বেনারকে জানান শ্রীরামপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নাসির উদ্দিন। 

নিহত কালামসহ বাংলাদেশিরা চোরাকারবারের গরু আনতে সীমান্তে গেলে বিএসএফ তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে বলে বেনারকে জানান বিজিবি ঝালঙ্গী বিজিবি ক্যাম্প কর্মকর্তারা। তবে নিহতের পরিবারের বরাত দিয়ে নাসির উদ্দিন বেনারকে জানান, “কালাম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে।” 

“কালামের মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী এবং চার শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেলো,” বলেন তিনি। 

এদিকে কালাম নিহতের ঘটনায় বিএসএফকে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে, পরবর্তীতে এ বিষয়ে পতাকা বৈঠক করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান রংপুর-৬১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোজাম্মেল হক। 

এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর পাটগ্রামের সীমান্তে জাহিদুল ইসলাম (২২) ও ১০ ডিসেম্বর আবু তালেব (৩২) নামের দুই বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এই দুজনসহ বিএসএফের গুলিতে মোট আট বাংলাদেশি মারা যান ডিসেম্বরে। 

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে, গত বছর বিএসএফের হাতে ৫১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ জন মারা গেছেন জানুয়ারিতে।

২০০০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বিএসএফ এক হাজার ২৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বলেও জানায় অধিকার। 

গত ১৭ ডিসেম্বরে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধে একমত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই মাসের ২২ তারিখ আসামের গৌহাটিতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে একমত হন কর্মকর্তারা। 

যদিও গৌহাটির বৈঠক চলাকালেই হালুয়াঘাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন এক বাংলাদেশি। 

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে “হিংসাত্মক সীমান্তে পরিণত করা হয়েছে,” মন্তব্য করে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটী রায় বেনারকে বলেন, “সীমান্তে হত্যা বন্ধ হওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে মানুষ হত্যার সাফাই হিসেবে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর গল্প ফাঁদা হয়।”

“এ জাতীয় হত্যাগুলোকে পুলিশ-প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ- কেউই যেন দেখতে পায় না,” বলেন কিরীটী রায়। 

বিভিন্ন সময় দুই দেশ সীমান্ত হত্যা বন্ধে একমত হলেও তা বন্ধ না হওয়ার মূল কারণ ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব’ বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. মইনুল ইসলাম।

তাঁর মতে, “অনুপ্রবেশ বা চোরাচালানের জন্য কাউকে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া আর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা এক নয়। এটা জঘন্য অপরাধ।” 

ভারতেও ক্ষোভ

এদিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে গত ২৯ ডিসেম্বর বিজিবির গুলিতে এক ভারতীয় নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ওপারের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত জেলা সাউথ গারো হিলসের স্থানীয় গ্রামবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন বলে চলতি সপ্তাহেই এক খবরে জানিয়েছে বিবিসি। 

মেঘালয়ের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, ৪৮ বছর বয়সী নিহত থেডিয়ান জি মোমিনকে বিজিবি মাদক চোরাকারবারি বলে চিহ্নিত করলেও তাঁর আদৌ কোনো অপরাধের রেকর্ড ছিল না। 

ওই ঘটনা প্রসঙ্গে ৩৯ বিজিবির ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তৌহিদ মাহমুদ বেনারকে জানান, ২৯ ডিসেম্বর ভোররাতে বিজিবির টহলদল চোরাকারবারি সন্দেহে আট-নয়জনের একটি দলকে চ্যালেঞ্জ করলে তাঁরা পালানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তাঁদের ছুঁড়ে মারা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে এক বিজিবি সদস্য আহত হন। 

টর্চের আলোয় ওই দলটিকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত দেখতে পেয়ে বিজিবি “আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়,” জানান এই কর্মকর্তা। 

২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিজিবির হাতে আট জন বেসামরিক ভারতীয় নাগরিক এবং দুই বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান কিরীটি রায়। 

“বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সাধারণত বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। সেই তুলনায় বিজিবির গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা অনেক কম,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।