মানবাধিকার সংগঠনের দাবি: সীমান্ত হত্যার জন্য বিএসএফকে জবাবদিহি করতে হবে

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.02.09
ঢাকা
মানবাধিকার সংগঠনের দাবি: সীমান্ত হত্যার জন্য বিএসএফকে জবাবদিহি করতে হবে রাজশাহীর পবা উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের টহল। ১৪ জুলাই ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সে দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। 

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী সীমান্তের দুই পাশে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিকদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিএসএফ সদস্যদের জবাবদিহি করতে না পারায় এমন ঘটনা ঘটছে। 

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, বিএসএফের গুলিতে গত জানুয়ারিতে কমপক্ষে পাঁচ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। 

“ভারত সরকার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সংযত আচরণ করতে এবং প্রাণঘাতী বুলেটের ব্যবহার বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়ার পরও নতুন করে হত্যা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হয়নি,” বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি। 

তিনি বলেন, “সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহি করতে সরকারের ব্যর্থতার কারণে দুই দেশের অতিদরিদ্র মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হয়রানি বন্ধ হয়নি।” 

এইচআরডব্লিউ জানায়, সীমান্তে সংযত আচরণ করতে এবং সীমান্তে হত্যা বন্ধে একাধিকবার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে ভারত সরকার। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এমন আশ্বাস দেয়া হয়। 

বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে উদ্ধৃত করে সংস্থাটি জানায়, ২০১১ সাল থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ৩৩৪ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। 

এইচআরডব্লিউ জানায়, ২০১১ সাল থেকে বিএসএফ’র হাতে নিহত ১০৫টি হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে ভারতীয় সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) বলেছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে। 

বেনারের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের গণমাধ্যম ফোকাল পয়েন্ট দেবব্রত পালের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। 

আলোচনা হলেও সমাধান হয় না 

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা অন্যতম প্রধান ইস্যু। প্রতি বছর বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিরা মারা যান। বিষয়টি নিয়ে বার বার আলোচনা হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২০ সালে সীমান্তে ৪২ বাংলাদেশিকে গুলি করে এবং ছয়জনকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। আহত হয়েছেন ২৬ জন এবং ২২ জন অপহৃত হয়েছেন। এর আগে ২০১৯ সালে সীমান্তে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮ জন। 

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কমপক্ষে পাঁচ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, একই মাসের ২১ তারিখে আসামে চারদিন ব্যাপী বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানায় বিজিবি। 

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, গরু চোরাচালানকেন্দ্রিক অপরাধীদের দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল আত্মরক্ষার্থে গুলি চালান বিএসএফ সদস্যরা। 

২০০৯-১০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রাণঘাতী বুলেটের পরিবর্তে বাংলাদেশ সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করবে বিএসএফ। 

রাবার বুলেট ব্যবহার শুরুর পর সীমান্তে হত্যা কমে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর আবার প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার শুরু করে বিএসএফ। 

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বেনারকে বলেন, “সীমান্তে হত্যার মতো অবাঞ্ছিত ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়।” 

“প্রতিটি বাহিনীরই আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর অধিকার রয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু সব সময় যে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো হয়, তা নয়। আবার প্রতিটি ঘটনার পর বিএসএফের জবাবের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না।” 

“বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। কিন্তু এই সীমান্ত খুবই নৃশংস,” মন্তব্য করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “এর কারণ হলো, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাদের সরকারের কাছ থেকে দায়মুক্তি ভোগ করে।” 

তাঁর মতে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উঠে এসেছে।

“এর ফলে ভারত সরকার কিছুটা হলেও চাপ অনুভব করবে এবং সীমান্ত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন কিছুটা হলেও কমবে,” বলেন নূর খান। 

সীমান্ত হত্যা ‘লজ্জার’

দশ বছর আগে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ শিরোনামে সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ জানায়, সেটি প্রকাশের পর ভারত সরকার বিএসএফকে অনিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপারকারীদের বিরুদ্ধে সংযত আচরণ এবং প্রাণঘাতী গুলির পরিবর্তে রাবার বুলেট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিল। 

এতদিন পরে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন সীমান্তে নিরপরাধ মানুষ হত্যার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, “এটা খুবই ইতিবাচক,” বলে মন্তব্য করেন সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করা সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায়।

তিনি বেনারকে বলেন, “বছরের পর বছর শান্তিপূর্ণ দুটি দেশের সীমান্তে হত্যা, বিচার না হওয়া এবং ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত লজ্জার।” 

তাঁর সংগঠন ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০৫টি সীমান্ত হত্যার তদন্ত করলেও প্রকৃত হত্যার সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে জানান মাসুম সম্পাদক। 

তিনি বলেন, “নিরপরাধ মানুষকে হত্যা এবং অন্যায়ভাবে মানুষকে নির্যাতন করার কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই বিএসএফ কর্তৃপক্ষ তাদের জওয়ান ও অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।” 

তাঁর মতে, “বিএসএফের মদতেই সীমান্তে চোরাচালান, মানুষ পাচার, গরু ও সোনা পাচারের মতো ঘটনা ঘটছে। পুলিশের একটি অংশের বিরুদ্ধেও এসব অভিযোগ রয়েছে।” 

এইচআরডব্লিউ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ বিষয়ে বিএসএফের জবাব পাওয়া যায়নি। 

তবে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত মহানির্দেশক পঙ্কজ কুমার সিং গত ১০ জানুয়ারি কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেন, “সীমান্তে সক্রিয় অপরাধীচক্রের সঙ্গে বিএসএফ-এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিএসএফ কর্তৃপক্ষ এখন অনেক বেশি সতর্ক।” 

তিনি বলেন, “সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু পাচার চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২-৩ জন অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়াও এক ডজনের বেশি অফিসার ও জওয়ানকে বদলি করা হয়েছে। তাঁদের সকলের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়েছে।” 

এদিকে কিছুদিন আগে সীমান্তে গরু পাচারের ঘটনা নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। সোমবার এই ঘটনায় সিবিআই বিশেষ আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে, যেখানে মোট সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এতে এক সময় মালদহ সীমান্তে কর্মরত বিএসএফের কমান্ডেন্ট সতীশ কুমারকেও অভিযুক্ত দেখানো হয়েছে। 

সীমান্তে গরু পাচার চক্রের সাথে যুক্ততার অভিযোগে গত নভেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। 

কলকাতা থেকে প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।