ভারতের প্রতি ইউনূস: শেখ হাসিনাকে ‘চুপ থাকতে হবে’
2024.09.06
ওয়াশিংটন ডিসি
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ভারতে থাকাকালে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই “চুপ করে থাকতে হবে” এবং বিচারের জন্য তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত ভারতকেই তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বর্তমানে “খারাপ অবস্থানে” রয়েছে বলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন ইউনূস।
প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পালানোর পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণকে নয়াদিল্লি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে নেওয়ায় এবং একমাত্র হাসিনাই স্থিতিশীল বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারেন-ভারতের এমন ধারণাকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালানোর তিন দিন পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হন নোবেলজয়ী ইউনূস। এর পর শেখ হাসিনা কখন প্রকাশ্যে কথা বলেছিলেন তা নির্দিষ্ট করেননি ইউনূস।
তবে ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনা ছেলের এক্স অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একটি পোস্টে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় নিহতদের বিচার দাবি করেছিলেন, যাকে তিনি "সন্ত্রাসী আগ্রাসন" বলে অভিহিত করেছিলেন।
ভারতে থাকার সময় হাসিনার বক্তব্যকে বাংলাদেশের প্রতি বৈরিতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, বলেছেন ইউনূস। তবে তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট নয় যে তিনি একে নয়াদিল্লির বৈরিতা নাকি হাসিনার বৈরিতা বলেছেন।
ঢাকায় তাঁর সরকারি বাসভবনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস পিটিআইকে বলেন, “যদি বাংলাদেশ ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত ভারত তাঁকে রাখতে চায়, তবে শর্ত হবে তাকে চুপ থাকতে হবে।"
বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে হাসিনাকে হস্তান্তরের দাবি জানাবে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তাঁকে ফিরিয়ে আনতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি পাবে না। তিনি যে ধরনের নৃশংসতা করেছেন, তাঁকে এখানে সবার সামনে বিচার করতে হবে।”
ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি উভয়েই হাসিনা প্রশাসনের পক্ষে ছিল। তবে আওয়ামী লীগ নেত্রী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
ড. ইউনূসের কাছে পিটিআইয়ের প্রশ্ন ছিল, ভারতে থাকা অবস্থায় হাসিনার বিবৃতি দেওয়াকে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে দেখছে তা ভারত সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল কিনা?
জবাবে ইউনূস বলেন, বার্তাটি মৌখিকভাবে ভারতকে জানানো হয়েছে।
“আমরা দৃঢ়ভাবে বলেছি, তাঁর চুপ থাকা উচিত। এটি আমাদের প্রতি একটি অবন্ধুসুলভ আচরণ; তাঁকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তিনি সেখান থেকে প্রচারণা চালাচ্ছেন,” বলেন ইউনূস।
“এটা এমন নয় যে তিনি সেখানে স্বাভাবিকভাবে গেছেন। জনগণের অভ্যুত্থান ও জনরোষের পর তিনি পালিয়ে গেছেন,” যোগ করেন তিনি।
ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের ধারণার পথপ্রদর্শক এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনার জন্য ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার পর থেকে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়েছে। পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূসও বিষয়টি অনেকটা স্বীকার করেছেন।
“আমাদের এই সম্পর্ক উন্নত করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যা এখন নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে,” তিনি বলেন।
তিনি অন্তত দুটি সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা সম্পর্ক ফাটলের দিকে নিয়ে গেছে।
একটি হলো, হাসিনার প্রতি নয়াদিল্লির অটল সমর্থন- এই ধারণার ভিত্তিতে যে তিনিই একমাত্র বাংলাদেশের নেতা যিনি ধর্মীয় চরমপন্থা দমনে এবং সীমান্তে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের দমাতে ইচ্ছুক ছিলেন।
ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথ হলো নয়াদিল্লিকে এই ধরনের “ব্যাখ্যা” থেকে সরে আসতে হবে।
২০০৯ সাল থেকে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী দলগুলোর প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ব্যাখ্যাটি হলো, সবাই ইসলামপন্থী; বিএনপি ইসলামপন্থী এবং বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং এই দেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করবে। শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিরাপদ রয়েছে।”
“ভারত এই বর্ণনায় বিমোহিত। ভারতকে এই ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আরেকটি প্রতিবেশী।”
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে নির্বাচন হলে বিরোধী দল বিএনপি বিজয়ী হবে।
শেখ হাসিনার প্রস্থানের পরে স্বাস্থ্যগতভাবে ভেঙে পড়া বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ভারতে তাঁকে পাকিস্তানপন্থী হিসাবে দেখা হয়।
২০০৬ সালের এপ্রিলে ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মেয়াদকাল “ভারতবিরোধী” বিভিন্ন বিবৃতির জন্য পরিচিত ছিল।”
খালেদা জিয়ার শাসনের সময় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সমস্যাগুলো উল্লেখ করে নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, "অবৈধ অভিবাসন, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং বাংলাদেশে জঙ্গিদের আস্তানার মতো বিতর্কিত ব্যাপারগুলো কণ্টকাকীর্ণ বিষয় হিসেবে রয়ে যাবে।”
বাংলাদেশের দিক থেকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে “ধর্মীয় অধিকারের উত্থান” দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করবে।
সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের ২০০৯ সালের সংখ্যায়, "বাংলাদেশ: ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য" শীর্ষক নিবন্ধে খালেদার কথিত ভারত-বিরোধী অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।
বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের দুর্বল করতে এবং ভারতকে অস্থিতিশীল করে রাখতে মৌলবাদী ও জিহাদিরা ছিল বেগম জিয়ার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির উল্লেখযোগ্য সহযোগী উপাদান।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিত।
“উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী বা নিরাপত্তা অভিযানের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল," যা তিনি ২০০৯ সালে করেছিলেন।
‘আক্রমণগুলো রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক নয়’
আরেকটি দিক যা ইউনূস এবং অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়েছে তা হলো, হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিষয়, যা নয়াদিল্লি অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরেছিল।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ হিন্দু। ইউনূস পিটিআইকে বলেন, হামলাগুলো সাম্প্রদায়িক ছিল না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অন্যান্য অ-হিন্দু সমর্থকদের ওপরও হামলা হয়েছে।
“আমি এটা মোদিকেও বলেছি যে এটা অতিরঞ্জিত। এই সমস্যাটির বিভিন্ন দিক রয়েছে,” ইউনূস বলেন।
“হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নৃশংসতার পরে দেশ যখন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের সঙ্গে যারা ছিল তারাও হামলার সম্মুখীন হয়। এখন আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের মারধর করার সময় তারা হিন্দুদের মেরেছে, কারণ একটা ধারণা রয়েছে বাংলাদেশে হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগ সমর্থক।"
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই হিন্দু-মুসলমানসহ সারাদেশে ভাংচুর ও মানুষের ওপর শারীরিক হামলার ঘটনা ঘটে।
তবে প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতার ভুয়া খবর সংক্রামকের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা এই ধরনের হামলার কথিত ঘটনাগুলো বিবিসি এবং এএফপি’র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ফ্যাক্ট চেকারদের দ্বারা খণ্ডন করা হয়েছিল। এদিকে আল জাজিরার মতো স্বনামধন্য সংবাদ সূত্রগুলো পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে বলেছে, ভীতিকর রিপোর্ট ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়া একটি বড়ো ভূমিকা পালন করেছে।
ইউনূস বলেন, হামলাগুলো মূলত হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই ঘটেছিল।
“এই হামলাগুলো রাজনৈতিক প্রকৃতির এবং সাম্প্রদায়িক নয়; এবং ভারত এই ঘটনাগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে,” পিটিআই-কে বলেন ইউনূস।
আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সহিংসতা এবং বিনা উস্কানিতে পুলিশি হামলার মাঝে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মারাত্মক রূপ নিলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ দেশব্যাপী গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
তিনি যখন পালিয়ে যান তখন বিক্ষোভকারী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে মোট প্রায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।