বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় ভারত

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার একশো দিনের বেশি সময় পার করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে মাত্র একবার টেলিফোনে কথা বলা ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আর কোনো পারস্পরিক যোগাযোগ হয়নি।

এই সময়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মধ্যে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়েছে। এর বাইরে এখন পর্যন্ত দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ে আর কোনো সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। প্রায় চার মাস ধরে বাংলাদেশিদের জন্য কার্যত ভিসা কার্যক্রমও বন্ধ রেখেছে ভারত।

বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার দেড় দশকেরও বেশি শাসনকালে প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছালেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্কে শিথিলতা এখন স্পষ্ট।

এদিকে গত আগস্টে ছাত্র ও গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি, হাসিনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে বলে নিয়মিত অভিযোগ করে আসছে দেশটি। দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের অবনতির মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত বিষয় এই দুটি।

000_36FN6GB.jpg
ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে এক বাংলাদেশি কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪। [এএফপি] (MUNIR UZ ZAMAN/AFP)

নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় ভারত

বিশ্লেষকদের মতে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের পরিবর্তে ভারত একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব দেবার কারণই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে দুদেশকেই কিছুটা বেগ পেতে হবে। তবে নির্বাচিত সরকার এলে এই স্থবিরতা কেটে যাবে বলে মনে করেন তাঁরা।

“ভারতের পলিসি মেকারদের ভুল ছিল যে তারা বাংলাদেশের জনগণের পরিবর্তে একটি দল আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কে জোর দিয়েছিল। যার ফল হিসেবে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেগেটিভিটি তৈরি হয়েছে,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।

তাঁর মতে দুই দেশের সম্পর্কের এই অবনতি “রাতারাতি পরিবর্তন হবে না।” সম্পর্কে স্বাভাবিক গতি আনতে ভরতকেই এগিয়ে আসতে হবে। “ভারতকে নিজেদের ভুল সংশোধন করে দলের পরিবর্তে জনগণকে গুরুত্ব দিতে হবে।”

ড. ইমতিয়াজ মনে করেন, “বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে ভারত। তাতে বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকারের সাথেই সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দেবে দিল্লী।”

এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী।

তিনি বেনারকে বলেন, “দুই দেশের সম্পর্কে যে অস্থিরতা এসেছে তা সাময়িক। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় মনে করা হচ্ছে এই দলটির সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো। তবে বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ ছিল না।”

প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত ভাগাভাগি করা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করতে দুদেশের নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দিল্লী অবশ্য নির্বাচিত সরকারকেই গুরুত্ব দেবে। আপাতত তারা অপেক্ষা করবে।”

দুদেশের সম্পর্কের এই টানাপোড়নের বিষয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কাছে বৃহস্পতিবার একটি প্রশ্ন পাঠানো হয়। উত্তর পাঠানোর কথা বলা হলেও রিপোর্টটি লেখা পর্যন্ত তাঁরা কোনো যোগাযোগ করেননি।

AP24226545493203.jpg
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারতের আহমেদাবাদে বিক্ষোভ। ১৩ আগস্ট ২০২৪। [এপি] (Ajit Solanki/AP)

লক্ষ্য একটি ভালো কর্ম সম্পর্ক

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করে পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “একটি দেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পরে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তবে উভয় পক্ষের সুবিধার জন্য এ সমস্যাগুলো অতিক্রম করে একটি ভালো কর্ম সম্পর্ক তৈরি করা আমাদের লক্ষ্য।”

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা-দিল্লী ফরেন অফিস কনসালটেশনের (এফওসি) যোগ দিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় আসছেন।

বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, দুই দেশ স্বাভাবিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এফওসি হবে এর প্রথম পদক্ষেপ।”

স্থবির সম্পর্ক

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর প্রায় চার মাস ধরে বাংলাদেশে ভিসা কার্যক্রম স্বাভাবিক করেনি ভারত। জরুরি কিছু মেডিকেল ভিসা ছাড়া ভারতের ভিসা পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা।

ছাত্র আন্দোলনের জেরে ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় খুলনা এবং কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী বন্ধন এক্সপ্রেস এবং নিউ জলপাইগুড়ি ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী মিতালি এক্সপ্রেসও। কবে থেকে এই ট্রেনগুলো আবার চালু হবে, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত দুই দেশের সরকারের পক্ষ কিছু জানানো হয়নি। তবে ভারতের সাথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।

এছাড়া বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারির সংস্থার কাজও। সেগুলো এখনো শুরু করা যায়নি। পাওনার দাবিতে প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ভারতের আদানি পাওয়ার কোম্পানি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে একজন কিশোরসহ দুই বাংলাদেশি নিহতের পৃথক পৃথক ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এসব প্রতিবাদপত্রে সবগুলো সীমান্ত হত্যার ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানানো হয়েছে।

তাছাড়া বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে শায়েস্তা করা’ বিষয়ক ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। এক প্রতিবাদলিপিতে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এ ধরনের আপত্তিজনক ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য থেকে বিরত রাখার জন্য উপদেশ দিতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দোষারোপ

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যা লঘু নির্যাতন নিয়ে সরব রয়েছে ভারত। যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি অতিরঞ্জিত দাবি করা হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্যা হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে প্রথম ফোনকলে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে এমন সংবাদ “অপপ্রচার।”

এর আগে বিবিসি হিন্দিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, এখানকার সংখ্যালঘুরা আমাদের নাগরিক। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এ বিষয়ে ভারতের কিছু বলার দরকার নেই।

2015-06-06T120000Z_1851927521_GF10000118874_RTRMADP_3_BANGLADESH-POLITICS.JPG
India's Prime Minister Modi waves with Bangladesh's Prime Minister Hasina at Shahjalal International Airport in Dhaka দুদিনের সফরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (ডানে) সাথে উপস্থিত জনতাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৬ জুন ২০১৫। [রয়টার্স] (Rafiquar Rahman/REUTERS)

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে অস্বস্তি

বাংলাদেশের পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। বিষয়টি নিয়ে দুদেশের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

ভারতে বসে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়াকে ভালোভাবে নিচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।

এদিকে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে বলেও সরকারের বিভিন্ন কর্তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তবে বিষয়টি সহজ নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা

তবে রাজাগোপাল ধরের মতে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকলেও শেখ হাসিনার বিষয়টিতে “রাজনৈতিক নেচার থাকায় এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।”

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্টের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার জানিয়েছে, শেখ হাসিনা ভারতে ‘সাময়িক’ আশ্রয় চেয়েছিলেন বলেই তা মঞ্জুর করেছে দিল্লী।