আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্পের খরচ ও সময় বাড়িয়েছে বাংলাদেশ
2022.02.08
ঢাকা
বাংলাদেশের সাথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও দুই দেশের মধ্যে চলাচল বৃদ্ধির জন্য পাঁচ বছর আগে গ্রহণ করা আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্পটির অচলাবস্থা নিরসনে খরচ ও সময় বাড়িয়েছে সরকার।
মঙ্গলবার পূর্বনির্ধারিত খরচ ও বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি করে প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৭ সালের প্রথম দিকে সরকারের অনুমোদন লাভ করার পর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাথে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আফকনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও প্রকল্পটির নির্ধারিত সময় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ করা যায়নি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উপসচিব শাহেদুর রহমান বেনারকে বলেন, মঙ্গলবার একনেক সভায় আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চার লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নতকরণ প্রকল্পটি সংশোধিত আকারে অনুমোদিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার সড়ককে এক লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করা হবে।
সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০১৭ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০২৫ সাল করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
কেন এই প্রকল্প?
‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। ভারত ও এই সাত রাজ্যের প্রায় মাঝখানে বাংলাদেশ অবস্থিত।
তবে, চিকেন-নেক বা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি করিডোর নামক সংকীর্ণ ভূমি দিয়ে ভারতের সাথে সেভেন সিস্টার্স সংযুক্ত। ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে ভারতীয় কৌশলবিদরা এই করিডোরকে নিরাপদ মনে করেন না। তাঁদের মতে, চীন এই করিডোর বন্ধ করে সাত রাজ্যকে দিল্লি থেকে আলাদা করতে পারে।
বাণিজ্যিকভাবেও এই সাত রাজ্যে ভারতীয় পণ্য ও সামরিক সরঞ্জামাদি পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।
সেকারণে স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করে খুব দ্রুতই ভারতীয় পণ্য পৌঁছাতে বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা দাবি করে আসছে ভারত সরকার।
বাংলাদেশের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশি পণ্য এই সাত রাজ্যে সস্তা। এটি বাংলাদেশি পণ্যের একটি ভালো বাজারও বটে।
২০১১ সালে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে দেয় বাংলাদেশ। তবে আশুগঞ্জ-আখাউড়া এক লেনের সড়কটি ট্রানজিট সুবিধার উপযুক্ত নয়।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভারত সরকারের ঘোষিত দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় যে কয়টি প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্প অন্যতম।
প্রকল্পটি ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে গৃহীত হয় এবং ওই বছরই সরকারের অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় এপ্রিল ২০১৭ থেকে জুন ২০২১। প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয় প্রায় তিন হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং ভারতীয় কোম্পানি অ্যাফকনের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পরও প্রকল্পটির খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
মঙ্গলবার একনেক সভায় এই প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ৭৯২ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করা হয়। বেনারের হাতে আসা প্রকল্পের বিবরণীতে দেখা যায়, মোট অর্থের মধ্যে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসাবে আসবে প্রায় দুই হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দেবে প্রায় দুই হাজার ৮০৯ কোটি টাকা।
কেন দেরি?
আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক খালেদ শাহেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, ভারতীয় ঋণের আওতায় সড়ক বিভাগ এর আগে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি; এটিই প্রথম প্রকল্প। সেকারণে এটি বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
তিনি বলেন, “আমরা এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ রেখেছিলাম ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের নতুন ভূমি অধিগ্রহণ নীতিমালা বাস্তবায়নের কারণে সেই অর্থ দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হচ্ছিল না। সেকারণে আমাদের প্রকল্পের জন্য বাড়তি ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। সেজন্য প্রকল্প সংশোধন করতে হয়।”
খালেদ শাহেদ বলেন, প্রকল্পের ধীরগতির আরেকটি কারণ হলো করোনাভাইরাস মহামারি। এ ছাড়া, প্রকল্পের মালামালের বিপরীতে শুল্ক পরিশোধ করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়।
প্রকল্পের লাভ কী?
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের সভাপতি রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ভারতের জন্য আশুগঞ্জ নদীবন্দর-আখাউড়া সড়ক প্রকল্পটি বাণিজ্যিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কলকাতা বন্দর থেকে ভারতীয় পণ্য নদীপথে সরাসরি আশুগঞ্জ নদীবন্দরে এনে সেখান থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই ভারতের আগরতলা।
তিনি বলেন, এই সড়ক ব্যবহার করে ভারত সহজেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে যেতে পারবে; এবং সেখানে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, তবে বাংলাদেশের জন্য এটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়; এখানে কৌশলগত কোনো বিষয় জড়িত নেই। হয়তো আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও কিছুটা বাড়বে। তবে ভারত বেশি লাভবান হবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এই সড়ক চার লেন করা হলে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এই প্রকল্প থেকে যে শুধু ভারতই লাভবান হবে তা নয়। বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।”
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সিমেন্ট ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ভারতের সাত রাজ্যে রপ্তানি করা হয় এবং ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির শতকরা ১০ ভাগ আসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে।