রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের পরিবেশ উন্নত, পিছিয়েছে অন্যরা

রিয়াদ হোসেন
2023.04.21
ঢাকা
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের পরিবেশ উন্নত, পিছিয়েছে অন্যরা চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিকরা পুরোনো জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা লোহার পাইপ কাটার সময় ভেতরে থাকা দাহ্য পদার্থে আগুন ধরে যায়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নত হলেও বৈশ্বিক নজরদারির বাইরে থাকায় অন্যান্য শিল্পখাতে দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে জরিপে বেরিয়ে এসেছে। ২৮ অক্টোবর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা, রানা প্লাজা ধসের পর আন্তর্জাতিক চাপ ও বেশকিছু উদ্যোগের ফলে গত এক দশকে তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ অনেকটাই উন্নত হয়েছে।

তবে একই সময়ে বৈশ্বিক নজরদারির বাইরে থাকায় পোশাক খতের বাইরে অন্যান্য শিল্পে দুর্ঘটনা কমেনি বরং বেড়েছে বলে জরিপে বেরিয়ে এসেছে, যা একাধিক বিশেষজ্ঞ সমর্থন করেছেন।

বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সেফটি এন্ড রাইটস সোসাইটির গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা  পরবর্তী ২০১৪ সাল থেকে পরের ৯ বছরে পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য খাতে দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৬০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।

সেফটি এন্ড রাইটস সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সেকান্দার আলী মিনা বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ ও ক্রেতাদের চাপে পোশাক খাতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ ছিল। ফলে কারখানা মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন।”

“কিন্তু পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে আন্তর্জাতিক ফোকাস নেই, চাপও পোশাকের খাতের মতো নয়। ফলে এসব খাতের শ্রমিকের সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিত রয়ে গেছে,” বলেন তিনি।

বেনারের কাছে একই মত প্রকাশ করেছেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন।

সরকারের পক্ষে কারখানার কর্মপরিবেশসহ শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই)।

ডিআইএফই’র মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদও পোশাক খাতের বাইরের অন্যান্য শিল্প খাত কর্মপরিবেশ বিবেচনায় পিছিয়ে রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।

বেনারকে তিনি বলেন, “রানা প্লাজার পর রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের ওপর বিদেশি চাপ ছিল, নানা শর্ত ছিল। যার কারণে তারা (কারখানা মালিকরা) তা মানতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু পোশাকের বাইরের খাতগুলো গতানুগতিক অবস্থায় ছিল।”

গত বছর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭১২ জন শ্রমিক

পোশাক খাতের শ্রমিক প্রতিনিধি ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রানা প্লাজা পরবর্তী সময়ে পোশাক খাতে মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড ছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্মার্ট ফ্যাশনস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগলেও সেখানে বড়ো ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

কিন্তু পোশাক খাতের বাইরে এই তালিকা বেশ লম্বা। সেফটি এন্ড রাইটস সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৬ সালে টাম্পাকো ফয়েল কারখানার অগ্নি দুর্ঘটনা, যাতে মারা যান ৪০ জন শ্রমিক। এছাড়া একই এলাকার রওজা হাইটেক লাক্সারি ফ্যান কারখানা, এস এস স্টিল কারখানা, রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে বিস্ফোরণ, কেরানীগঞ্জের প্রাইম পেট এন্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে গ্যাসের লাইনের বিস্ফোরণ, হাশেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানায় বিস্ফোরণ, চট্টগ্রামের সীমা অক্সিজেন কারখানায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো উল্লেখযোগ্য।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৭১২ জন শ্রমিক মারা গেছেন, যা গত ৯ বছরের মধ্যে একক কোনো বছরে সর্বোচ্চ।

অগ্নিকাণ্ড ছাড়াও অন্যান্য দুর্ঘটনা এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা কর্মক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে।

তবে ২০১৭ সালে গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামে একটি বয়লার দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হওয়া ছাড়া পোশাক খাতে বড়ো দুর্ঘটনা কিংবা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশে গত ১০ বছরে পোশাক খাতের কর্মপরিবেশের উন্নতি হয়েছে বলে উন্নয়ন সহযোগী এবং বিদেশী বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মত প্রকাশ করা হয়েছে।

গত ১৩ এপ্রিল রানা প্লাজার ১০ বছর উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, “বাংলাদেশ যে অগ্রগতি (পোশাক খাতের নিরাপত্তা রক্ষায়) আমরা তা স্বীকার করি।”

অবশ্য তার বক্তব্যেও পোশাক খাতের বাইরের অন্যান্য খাতের নিরাপত্তায় গুরুত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি গত ৪ এপ্রিল ঢাকার অতি পরিচিত বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডসহ একাধিক অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, “এসব ঘটনা এই বার্তা দিচ্ছে যে, সব ধরনের শিল্পে শ্রম আইনের কঠোর তদারকি দরকার।”

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বেনারকে বলেন, “অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ বৈশ্বিক সব পক্ষের সহায়তায় ১০ বছরে বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন অনেক নিরাপদ।”

“তবে এ জন্য প্রতিটি কারখানার ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা করে গড়ে ব্যয় করতে হয়েছে,” উল্লেখ করেন তিনি।

তদারকির তালিকায় ৪৫ হাজার কারখানা

২০২১ সালে হাশেম ফুডস এর অগ্নিকাণ্ডের পর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তত্ত্বাবধানে দেশের কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে এ কাজটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।

ডিআইএফ’র তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৫ হাজার কারখানা ও মার্কেট চিহ্নিত করা হয়েছে।

ডিআইএফই’র মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন,” চিহ্নিত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে ৫ হাজার ২০৬টি পরিদর্শন করা হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকি বিবেচনায় সংস্কারের জন্য তিন মাস থেকে ১ বছর সময় দিয়ে শিগগিরি চিঠি দেওয়া হবে।”

১০ বছরেও বিচার শেষ হয়নি

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হলেও গত ১০ বছরেও ওই মামলার বিচার শেষ হয়নি। বরং গত ৬ এপ্রিল হাইকোর্ট এ মামলার মূল আসামী সোহেল রানার জামিন মঞ্জুর করেন। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পর ৯ এপ্রিল চেম্বার আদালত জামিন না মঞ্জুর করেন।

রানা প্লাজা ধসের পর সাভার পুলিশ স্টেশনের উপ-পরিদর্শক ওয়ালী আশরাফ নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত কারণে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তের পর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা জেলা আদালতের অধীনে আছে। এদিকে এতদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ‘ক্ষুব্ধ’ পোশাক

শ্রমিক নেত্রী ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর এ মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়ার জন্য আর কী প্রমাণ লাগে? এই মামলার বিচার তো ছয় মাসে শেষ হওয়ার কথা। ১০ বছরেও বিচার না হওয়া মৃত শ্রমিকদের প্রতি অসম্মান ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।”

শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ এডভোকেট জাফরুল হাসান শরিফ বেনারকে তিনি বলেন, “দেশের সম্মানের জন্য এই মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন হওয়া উচিত। এতে দেশেরও ভাবমূর্তি বাড়বে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।