পশ্চিমা দেশ এবং জাপানের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশের অবস্থান বদল

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.27
ঢাকা
পশ্চিমা দেশ এবং জাপানের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশের অবস্থান বদল টোকিওতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্বাক্ষরের পর যৌথ বিবৃতি বিনিময় করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বামে) এবং জাপানি প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও। ২৬ এপ্রিল ২০২৩।
[সৌজন্যে: তথ্য অধিদফতর]

জাপানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পূর্ববর্তী অবস্থান অনেকটা পাল্টে বাংলাদেশ জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ জাতিসংঘ সনদসহ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং আইনের শাসনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি।

এই যুদ্ধ শুধু ইউরোপ নয়, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে এর প্রভাব পড়বে বলে বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা বাংলাদেশ-জাপান যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের ওপর এই যৌথ বিবৃতি প্রস্তুত করা হয়।

ইউক্রেনের জনগণের প্রতি ধারাবাহিক সমর্থন প্রকাশ করে দুই দেশ বলেছে, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের হুমকি অগ্রহণযোগ্য।

উল্লেখ্য, রাশিয়া প্রয়োজনে ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়ে আসছে।

যৌথ বিবৃতিতে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে প্রতিবেশীদের বিরোধ, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র এবং ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মন্তব্য করল যা পশ্চিমা দেশ এবং জাপানের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এর ফলে বাংলাদেশের দুই বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন ও রাশিয়া, প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্কে কিছু অস্বস্তি আসতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

চীন ও রাশিয়ার জন্য ‘কিছুটা অস্বস্তিকর’ হতে পারে

২৫ এপ্রিল থেকে জাপান সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং এই সফরে বাংলাদেশে আরো জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং দুই দেশের মধ্যে উন্নয়ন সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে মোট আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

এগুলোর অন্যতম হলো জাপানের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা, যা আগে ছিল না।

গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভোটাভুটিতে একটি ছাড়া সবটিতে ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশ এবং জাপানের অবস্থানের আলোকে যে ভোটাভুটিতে পক্ষে ভোট দেয় সেটি ছিল ইউক্রেনে মানবিক সহায়তা প্রদান এবং যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান সম্পর্কিত।

সর্বশেষ ৫ এপ্রিল ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন বন্ধে রাশিয়াকে আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব আনা হয়। ওই ভোটাভুটিতেও বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়ার সাথে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। এছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেকারণে রাশিয়ার সমালোচনা থেকে বিরত ছিল বাংলাদেশ।

কেন হঠাৎ এই পরিবর্তন-এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আগের চেয়ে একটি ভিন্ন অবস্থান নিয়ে এই যুদ্ধের সমালোচনা করেছে।

তিনি বলেন, “হতে পারে এই বিষয়টিকে একেবারে এড়িয়ে যেতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ এই যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছে।”

ড. ইমতিয়াজ বলেন, “এই যুদ্ধের ফলে জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘিত হয়েছে এবং ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছে বাংলাদেশ। তবে এই যৌথ বিবৃতির কোথাও রাশিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশ এখানে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে।”

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ জাতিসংঘে ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটাভুটিতে একটি বাদে সবগুলোতে ভোটদানে বিরত ছিল। তবে ইউক্রেন প্রশ্নে জাপানের অবস্থান পশ্চিমাদের মতোই।”

তিনি বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশ জাপানের সাথে সকল ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় সেহেতু তাকে জাপানের অবস্থানের সাথে মিল রাখতে হবে। সে কারণে হয়তো বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে।”

হুমায়ূন কবির বলেন, “তবে বাংলাদেশ বরাবর ইউক্রেনের অখণ্ডতার ব্যাপারে বলে আসছে। যৌথ বিবৃতিতে এই বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ কিছুটা ভারসাম্য এনেছে।”

তিনি বলেন, “যৌথ বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে তার সরল ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশ বৈদেশিক সম্পর্কের দিক থেকে একটি নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করছে।”

রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, “সব মিলিয়ে এই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেকটা পশ্চিমা অবস্থানের দিকে গেলেও ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশের ব্যাপারে চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তিকর বোধ আসতে পারে।”

পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর প্রসঙ্গ

এই অঞ্চলে চীনের সাথে তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমা বিরোধ রয়েছে। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, চীন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং কৃত্রিম ভূখণ্ড নির্মাণ করে ওই অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। চীন তার ইচ্ছামত সমুদ্রাঞ্চল অঙ্কন করে প্রতিবেশীদের অঞ্চল দখল করেছে।

জাতিসংঘ সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সম্পর্কিত যে রায় দিয়েছে তা চীনের বিপক্ষে। তবে চীন জাতিসংঘের এ-সংক্রান্ত আইন মানছে না। 

এ প্রসঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা।

এতে বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী ১৯৮২ সালের আনক্লজের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং জানান, এককভাবে শক্তি দিয়ে অথবা জোর করে এই অঞ্চলের স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হলে সেটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ করবে এবং আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করবে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

উত্তর কোরিয়ার প্রতি আহ্বান

যৌথ বিবৃতিতে জাপানের চিরশত্রু হিসাবে পরিচিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র এবং ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয়। উত্তর কোরিয়ার প্রতি এ-সংক্রান্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে চলার আহ্বান জানান দুই প্রধানমন্ত্রী।

একইসাথে উত্তর কোরিয়ায় মানবিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে উদ্বেগ রয়েছে তা বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানানো হয়।

মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান

মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটিতে সহিংসতা ও যুদ্ধ বন্ধ করার পাশাপাশি আটক ব‌্যক্তিদের মুক্তি দিতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে।

বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে মিয়ানমারের পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে উল্লেখ করে এ ব‌্যাপারে মিয়ানমারের কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ কাজের আহ্বান জানানো হয় যৌথ বিবৃতিতে।

এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ব‌্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালো বাংলাদেশ।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে পশ্চিমা মিত্র ও দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সূ চি সরকারকে উৎখাত করেন সামরিক শাসক ও চীনা সমর্থক জেনারেল অং মিন লাইং।

এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে কারারুদ্ধ সূ চি’র দল ন‌্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। সামরিক সরকার হাজার হাজার এনএলডি সমর্থককে আটক করেছে।

ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে সকল আটক রাজনৈতিক ব‌্যক্তিদের মুক্তি দিয়ে গণতান্ত্রিক ব‌্যবস্থা পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানিয়ে আসছে পশ্চিমা সরকারগুলো।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “পূর্ব এবং দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ কোনো মন্তব্য করে না। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এই বিষয়ে মন্তব্য করল। এই মন্তব্য জাপানের অবস্থান বলা যায়।”

হুমায়ূন কবির বলেন, “একইভাবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা এবং ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ব্যাপারে আমরা সাধারণত কোনো কথা বলি না। এখানেও জাপানের অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছে।”

“মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আটক বন্দিদের মুক্তির দাবি মূলত পশ্চিমাদের অবস্থান। এখানেও বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলল,” যোগ করেন হুমায়ূন কবির।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।