তিন দেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী, লক্ষ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.25
ঢাকা
তিন দেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী, লক্ষ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টোকিওর হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। ২৫ এপ্রিল ২০২৩।
[সৌজন্যে: তথ্য অধিদফতর]

বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে জাপানের আরো বেশি অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগ বাড়াতে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মঙ্গলবার জাপানে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাপান থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর করবেন। সব মিলিয়ে এপ্রিল ২৫ থেকে ৮ মে পর্যন্ত এই তিন দেশ সফরে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী।

সফরের আগের দিন সোমবার প্রথমবারের মতো জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের দেয়া ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আক্রমণাত্মক প্রভাব কমাতে গৃহীত এই কৌশল সম্পর্কে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিষ্কার করল।

এছাড়াও নির্বাচনের বছরে পশ্চিমা দেশগুলো সফর করে বাংলাদেশের সাথে ওইসব দেশের চলমান টানাপোড়েনের অবসান ঘটানো অন্যতম লক্ষ্য বলে তাঁরা মনে করছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২৫ থেকে ২৮ এপ্রিল জাপানে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা জাপানের সম্রাট নারিহিতো এবং প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সাথে বৈঠকে মিলিত হবেন।

প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকালে কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্প, জাহাজ পুনঃচক্রায়ন, শুল্ক, প্রতিরক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোট আটটি চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের সাথে সহযোগিতার ৫০ বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জাপান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাবেন প্রধানমন্ত্রী এবং ৪ মে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়বেন। ৪ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি।

নতুন দিক প্রতিরক্ষা খাত

প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর “খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ” বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, জাপানের সাথে সহযোগিতার মধ্যে একটি নতুন দিক হলো প্রতিরক্ষা খাত। পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনও কোনো সামরিক জোটে যুক্ত হয় না, দ্বিপাক্ষিকভাবে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে। যেমন বাংলাদেশের সাথে চীন, ভারত, ব্রিটেন, রাশিয়া ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতা রয়েছে।

সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ভারত সফরে গিয়ে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ ও ভারতকে ঘিরে তাঁর সরকারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এবং বাংলাদেশের বিশাল বাজারকে কেন্দ্র করে দেশটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কিছু রাজ্যের সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে জানিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “জাপান এই খাতে বিনিয়োগ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারে।”

তিনি বলেন, “জাপান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র এবং তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। জাপান এই অঞ্চলের বাজারকে তার কাজে লাগাতে চায়।”

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরহ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে চীন সরকার। বঙ্গোপসাগর ঘিরে চীনের বিরাট এই বিনিয়োগের বিপরীতে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে জাপান বিনিয়োগ করছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, “এটা হতে পারে। জাপান এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ এবং তারা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অন্যতম প্রধান সদস্য।”

২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারতের আইনসভায় বক্তৃতায় ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে এক করে দেখার নীতির কথা জানান। এরপর থেকে বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পায়। ২০১৬ সাথে কেনিয়ায় এক বক্তৃতায় ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে একটি অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করে এটিকে বাধাহীন ও মুক্ত করার ধারণা তুলে ধরেন তিনি।

এরপর গৃহীত হয় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। এই কৌশলের অংশীদার অন্যতম দেশগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাজ্য।

চীন অভিযোগ করে আসছে, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মূল উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করা।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি এর আলোকে ২০২২ সালে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এই নতুন জোটে যোগ দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এই মন্তব্যের জন্য তিনি সমালোচনার মুখেও পড়েন।

তিনি বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওই মন্তব্যের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক সংক্রান্ত কোনো জোটে যোগ না দেয়ার জন্য হুমকি প্রদান করেছিলেন চীনা রাষ্ট্রদূত।

পরিস্থিতি বদল হয়েছে

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকেও পশ্চিমাদের সমালোচনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এই ধারণা এসেছে যে, পশ্চিমাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “পরিস্থিতি বদল হয়েছে। আগে পশ্চিমারা সমালোচনা করলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু বলা হতো না। এখন বাংলাদেশও দুকথা বলে দেয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এমনটি দেখা যায়।”

রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ বলেন, “তবে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ নয়। পশ্চিমারা যে সমালোচনা করে সেটি তাদের একটি কূটনৈতিক কৌশল। আবার বাংলাদেশ যে পশ্চিমাদের সমালোচনা করে সেটিও বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল।”

তিনি বলেন, কৌশলগত কারণে “বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের যতটুকু দরকার যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের আরও বেশি দরকার। সুতরাং, এই সফরের মাধ্যমে পশ্চিমাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হবে বলে মনে হয়।”

এর আগে গত নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত করা হয়। এর প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কর্নেল (অব.) ফারুক খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর বিভিন্ন কারণে স্থগিত হয়েছিল। সেই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।”

“জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জাপানের আরও বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস,” বলেন ফারুক খান।

“এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা করবে জাপান সরকার,” জানিয়ে তিনি বলেন, “জাপান হয়তো চাইবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু গতকাল (সোমবার) সরকার বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করেছে।”

“বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে থাকতে পারে। তবে কোনোভাবেই অন্য দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যাবে না। আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ অনুযায়ী চলব,” বলেন ফারুক খান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।