পালিয়ে ভারত যাওয়ার পথে আটক সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত

আহম্মদ ফয়েজ
2024.09.16
ঢাকা
পালিয়ে ভারত যাওয়ার পথে আটক সম্পাদক  মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এডিটরস গিল্ডের সভাপতি সভাপতি মোজাম্মেল বাবু (আরাফাতের বামপাশে) ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত (আরাফাতের ডানপাশে)। ঢাকা, ৭ জানুয়ারি ২০২৪।
[সৌজন্যে: তথ্য অধিদপ্তর]

স্থানীয় জনতার সহায়তায় আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের দুই প্রভাবশালী সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সোমবার ভোরে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় জনতা তাঁদের আটক করে স্থানীয় পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মো. আজিজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আটককৃতদের ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানেই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

এ ঘটনায় একজন গাড়িচালক ও একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিককেও আটক করেছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “আটকৃতদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাঁরা ঢাকার পথে (রাত ৮টা পর্যন্ত) রয়েছেন, ঢাকায় নিয়ে আসা হলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আটক সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু এডিটরস্ গিল্ড নামে সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের সভাপতি। তিনি দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

শ্যামল দত্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক। তাঁরা দুজনই নিজেদের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে প্রচার চালাতেন।

এমনকি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার দুদিন আগে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই দুই সাংবাদিক উপস্থিতি থেকে আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনাকে নানা পরামর্শ দেন।

IMG_6703.jpg
একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। ফাইল ছবি কোলাজ। ছবি: বেনারনিউজ।

তাঁরা দুজনই গোঁফ ও দাড়ি কামিয়ে এবং ছোট করে নিজেদের চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন বলে দেখা গেছে আটকের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে।

এর আগে শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় শ্যামল দত্তকে স্ত্রী-কন্যাসহ ইমিগ্রেশন থেকে ফেরত পাঠানো হয়।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গঠিত মিডিয়া উপ-কমিটি সদস্য সচিব ছিলেন মোজাম্মেল বাবু।

এ ছাড়া ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে ৫১ সাংবাদিকের তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখানেও এই দুই সাংবাদিকের নাম রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘সাংবাদিকতার আড়ালে জাতীয় স্বার্থ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদেরকে কর্মস্থল থেকে বহিষ্কার এবং সাংবাদিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। পরে শ্যামল দত্তকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার ও প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করা হয়।

এর আগে বিদেশে যাবার সময় গত ২১ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপাকে।

শাকিল একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা প্রধান এবং রূপা একই টেলিভিশনের প্রিন্সিপাল করেসপন্ডেন্ট ছিলেন। তাঁদেরকে দুটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল, সেখানে শাকিল ও রূপার নামও ছিল। সরকার পতনের পরপর গত ৮ আগস্ট শাকিল ও রূপাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার ঘটনায় উদ্বেগ

এই চার জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হলেও বিভিন্ন হত্যা মামলায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিককে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ঢালাওভাবে এসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) এবং ল’ রিপোর্টার্স ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।

শনিবার এক বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, এ ধরনের মামলা দেওয়ার প্রবণতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে।

পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বিবৃতিতে বলেন, “ঢালাও অভিযোগের ভিত্তিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার ঘটনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের মামলা প্রচলিত আইনের অপব্যবহারের শামিল। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতিরও লঙ্ঘন।”

এ অবস্থায় যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে মামলা থেকে দ্রুত অব্যাহতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পরিষদ।

এ বিষয়ে ডিআরইউয়ের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন বেনারকে বলেন, “যেসব সাংবাদিক দালালি করে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আমরা চাই তারা জবাবদিহিতার আওতায় আসুক।”

“কিন্তু গণহারে হত্যা মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করার বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত স্পষ্ট অবস্থান না নেয়, তাহলে তাদেরকে নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে,” মনে করেন এই সাংবাদিক নেতা।

মামলা পর্যালোচনা করবে সরকার: তথ্য উপদেষ্টা

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে তিনটি হত্যা মামলায় অন্তত ৫০ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যারা রাজনৈতিক সক্রিয়তা কখনো দেখান নি।

গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার ভাসানটেক থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর মিরপুরে নিহত মো. ফজলুরের ভাই মো. সবুজ।

এই মামলায় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে ২৫ জন সাংবাদিককে।

এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বেনারকে বলেন, "ইতোমধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে এভাবে গণহারে আসামি করার বিষয়টি বন্ধ করা হয়।"

যেসব হত্যা মামলায় সাংবাদিকরা আসামি হয়ে গেছেন তাদের বিষয়ে নাহিদ বলেন, "এই মামলাগুলো সরকার খুব দ্রুতই পর্যালোচনা করবে। এতে যে নামগুলো মামলা থেকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ জানাবো।"

“তবে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে যারা লেখনী ও অন্যান্য উপায়ে সহায়তা করেছে তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। স্বৈরাচারের দোসরদের আইনের আওতায় আনাও এই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব," বলেন তিনি। 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।