ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত ১২১ শিশুকে মুক্তির নির্দেশ দিল হাইকোর্ট

জেসমিন পাপড়ি
2019.10.31
ঢাকা
ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত ১২১ শিশুকে  মুক্তির নির্দেশ দিল হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণের একটি ছবি। ঢাকা, মে ১৬, ২০১৮।
ছবি: এএফপি

ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত হয়ে যশোর ও টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা ১২১ শিশুর মধ্যে ১২ বছরের কম বয়সীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল হালিম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আবদুল হালিম বেনারকে বলেন, “শিশুদের বিচার করা বা দণ্ড দেওয়ার কোনো এখতিয়ার ভ্রাম্যমান আদালতের নেই।”

পাশাপাশি ১২ বছরের বেশি শিশুদের ছয় মাসের জামিন দেওয়া হয়েছে। জামিননামা দাখিলের পর সংশ্লিষ্ট শিশুরা আদালতের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে মুক্তি পাবে।

বৃহস্পতিবার স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ এ আদেশ দেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেয় আদালত।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনে না থাকলেও চলতি বছরের ৩ মে থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ১২১ শিশুকে বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডিত করেছে। দণ্ডিত এসব শিশুদের টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৮ জন শিশুর বয়স ১৭ বছর। ২৬ জনের বয়স ১৬ বছর, ২০ জনের বয়স ১৫ বছর, ১৬ জনের বয়স ১৪ বছর, ১১ জনের বয়স ১২ বছর।

দণ্ডিত শিশুদের মধ্যে সাতজনের বয়স ১৩। বাকি ১২ জনের বয়স ৮ থেকে ১১ বছর। আর একজনের বয়স উল্লেখ নেই।

আব্দুল হালিম  এবং অপর আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোর  প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার আদালতের নজরে এনে শুনানিতে অংশ নেন।

এ ছাড়া যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রেও ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত একটি শিশু আছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কিছু জরুরি কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারলেও শিশু আদালত ছাড়া শিশুদের বিচার করার এখতিয়ার কারও নেই। যারা এসব শিশুদের দণ্ডিত করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী সালমা আলী বেনারকে বলেন, “আমাদের কোনো সমন্বয় নেই। জরুরি কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই বলে তারা অন্যায়ভাবে কাউকে দণ্ডিত করতে পারে না।”

“কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তারা যা করেছে তা স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘণ। এভাবে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় আইনের শাসন ব্যাহত হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়ে।”

তিনি বলেন, শিশু আইনেও বলা আছে, শিশুরা কোনো অপরাধ করে থাকলে তাদের বিচার শুধু মাত্র শিশু আদালতেই হবে।”

প্রথম আলোর বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে এনে শুনানিতে অংশ নেন চিলড্রেন’স চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (সিসিবি ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল হালিম এবং সিসিবি ফাউন্ডেশনের পরিচালক আইনজীবী ইশরাত হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

আবদুল হালিম বেনারকে বলেন, “শিশুদের বিচার করা বা দণ্ড দেওয়ার কোনো এখতিয়ার ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেই।”

শুনানি শেষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেওয়া রুলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শিশুদের দেওয়া আটক, বিচার ও দণ্ডাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

জানা যায়, স্বরাষ্ট্র, আইন, জনপ্রশাসন, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব, র‍্যাবের মহাপরিচালক, টঙ্গী ও যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, র‍্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম, র‍্যাব-৩ টিকাটুলির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আক্তারুজ্জামান, র‍্যাব-৪ মিরপুর-১ এর আইন কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ১৮ নভেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য্য করা হয়।

যেসব অপরাধে সাজা

টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত শিশুদের মধ্যে ৭৫ জনকে দণ্ডবিধির ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী চুরির দায়ে ছয় মাস এবং ৩৪ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী এক বছর করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে তারা কী ধরনের অপরাধ করেছে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ১৩ বছর বয়সী একটি শিশু ছয় মাসের সাজা পেয়েছে দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারায়। সরকারি কর্মচারীকে ক্ষতিসাধনের হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

২০১৩ সালের শিশু আইনে বলা হয়েছে, “বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।”

এই আইনের ১৬ ধারা বলছে, “আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু কর্তৃক সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করবার জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে এক বা একাধিক শিশু আদালত থাকবে। কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু একত্রে জড়িত থাকলেও শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতই করবে।”

এই ধারা অনুযায়ী, শিশু আদালতেরও সাজসজ্জা ও ধরন ভিন্ন হতে হবে। অপরাধ অজামিনযোগ্য হোক বা না হোক, আদালত শিশুকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে। এমনকি আদালতে শিশুর প্রথম হাজির করবার ২১ দিনের মধ্যে প্রবেশন কর্মকর্তা একটি সামাজিক অনুসন্ধান দাখিল করবেন। প্রবেশন কর্মকর্তা বা বৈধ অভিভাবকসহ আইনজীবীর উপস্থিতি আদালতে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।”

আইনের এসব ধারা ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন “শিশু আইনে স্পষ্টত এসব বিষয় উল্লেখ থাকার পরেও কেন ভ্রাম্যমাণ আদালত শিশুদের দণ্ডিত করেছে সেটা সেটা বোধগম্য নয়। প্রয়োজনে তাদের আইনের আওতায় নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “মারাত্মক কোনো অপরাধের সাথেও যদি শিশুরা সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তাহলেও তাদের আটক করে কখনো জেলখানায় পাঠানো যাবে না। দাগি কয়েদির সাথে রাখা যাবে না। এমন একটি স্থানে তাদের রাখতে হবে যেখানে তাদের উন্নয়ন হয়। মানসিক বিকাশ হয়।”

বাংলাদেশের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে এ ধরনের সুযোগ নেই উল্লেখ করে আইনজীবী সালমা আলী বলেন, আমাদের উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে ধারণ ক্ষমতা ক্ষমতা অনেক কম। শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাপোর্ট সেখানে নেই। এমনকি পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সুযোগও তারা পায় না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।