বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন
2023.04.28
ঢাকা

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বব্যাংক তিনটি প্রকল্পের অধীনে নতুন করে ১২৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। শুক্রবার সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতু থেকে ঋণ প্রত্যাহার করার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি সংস্থাটির ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেনি।
এই ঋণ এমন এক সময়ে অনুমোদন হলো, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে আগামী ১ মে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন। তিনি শুক্রবার ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে টোকিও ছেড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) এ অর্থায়নের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের এ সভায় ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (সিপিএফ) নিয়েও আলোচনা হয়। সিপিএফ হলো বাংলাদেশকে সংস্থাটির ঋণ সহায়তার কৌশলপত্র।
সংস্থাটির বোর্ড সভায় বাংলাদেশের জন্য তিনটি আলাদা ঋণ অনুমোদনকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “একই সভায় বাংলাদেশের জন্য তিনটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের এমন নজির আছে বলে তার জানা নেই।”
বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স (পার্টনার) প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ। এই অর্থ কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা, উদ্যোক্তা তৈরি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সহনশীলতা প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হবে।
২৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আরও গতিশীল, কম দূষণকারী ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা তৈরিতে ব্যয় করা হবে।
মোট এই ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্থ আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়নকালে পাওয়া যাবে।
বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে গ্রিন অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির আওতায়। এই অর্থ দেশকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে রূপান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সহনশীলতা উন্নয়নে ব্যয় হবে।
তবে নতুন এই ঋণের অর্থ কোন সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে কিংবা সূদের হার কত হবে, তা অবশ্য বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ওয়াশিংটনে ওই অনুষ্ঠানে নতুন এ তিনটি প্রকল্পের ঋণ ছাড়াও আরো তিনটি প্রকল্পসহ মোট ৬টি প্রকল্পের অধীনে ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে।
রিজার্ভ সংকটে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে
গত ৩১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের নতুন এ ঋণের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি তৈরি করেছে। চলমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট কমানোর ক্ষেত্রে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে এবং আশা করা যায়, আগামী এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ তা পেয়ে যাবে।”
“আইএমএফ এর হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভে এখনো ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি মেটাতে বাজেট সহায়তা হিসেবে আসা ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়ক হবে,” যোগ করেন তিনি।
ড. জাহিদ বলেন, “এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু অর্থ পাওয়া যাবে চলতি অর্থবছরে, যা রিজার্ভের ঘাটতি কমাতে সহায়ক হবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমানও বেনারকে বলেন, “এই ঋণ সরকারের রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ) বাড়াতে কাজে লাগবে।”
সংস্থাটি চলতি অর্থবছরে বাজেট সহায়তা হিসেবে আরো ২৫০ মিলিয়ন ডলার করে দুই দফায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
নতুন সিপিএফ সংস্কার কাজে সহায়ক হবে
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সিপিএফ সরকারের মূল প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।”
বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আবদুলায়ে সেক বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশের আরো সমৃদ্ধশালী হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে, সেজন্য উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রয়োজন অনুসারে দেশটিকে আরো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও নীতিমালা তৈরির দরকার হবে। কর্মসংস্থান এবং অন্তর্ভুক্তি ও সহনশীলতায় সহায়তার লক্ষ্যে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে এই সিপিএফ সহায়তা করবে।”
আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত নতুন এই সিপিএফ যেসব উদ্দেশ্য পূরণে কাজ করবে, তার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক-ভিত্তিক বেসরকারি খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যবসায়ের পরিবেশের অগ্রগতি, দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি ও সহনশীলতার জন্য আর্থিক ইন্টারমিডিয়েশনের জোরদারকরণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোসহ আটটি উদ্দেশ্য।
নতুন এ সিপিএফ প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক পরামর্শ করেছে বলেও জানা গেছে।
গত জানুয়ারির শেষ দিকে আইএমএফ বাংলাদেশকে বড়ো অঙ্কের যে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আস্থা বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলা ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আইএমএফ আসায় অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা উৎসাহী হয়েছে। আইএমএফ-এর নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঋণ সহায়তা আসে। সেক্ষেত্রে অন্যরা মনে করে, দেশটি ঠিকই আছে। আমরাও আসতে পারি। তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়।”
পদ্মা সেতু ইস্যু ঋণপ্রাপ্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১২ সালে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে কড়া সমালোচনা করা হয়। বাংলাদেশকে সংস্থাটির পরবর্তী ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তা কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন অনুমোদিত সোয়া এক বিলিয়ন ডলারসহ বাংলাদেশ বর্তমানে সংস্থাটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) আওতায় চলমান ঋণের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা একক দেশ হিসেবে সংস্থাটির সর্বোচ্চ বরাদ্দকৃত ঋণ। এই ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই এসেছে ২০১২ সালের পর।
এছাড়া সংস্থাটির অপর দুই অঙ্গ সংস্থা মাল্টি লেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি’র (মিগা) অধীনে এক বিলিয়ন ডলারের উপরে এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) অধীনে আরো প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ কার্যক্রম চালু রয়েছে বাংলাদেশে।
“এই ঋণের বড়ো অংশই এসেছে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত ইস্যুর পরে। তার মানে পদ্মা সেতুর বিষয়টি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেনি,” বলেন ড. জাহিদ হোসেন। একই মত প্রকাশ করেছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমানও।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকায়
আইএমএফ-এর ঋণের মধ্যে প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী জুলাইয়ের পর পাবে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ। তবে ঋণ পাওয়ার জন্য সংস্থাটি বাংলাদেশকে ছোট-বড়ো ৩০টির বেশি সংস্কার বাস্তবায়নের সময়াবদ্ধ শর্ত দিয়েছে।
বর্তমানে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করছেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। আগামী ২ মে প্রতিনিধিদলের ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।