বাংলাদেশি কর্মীদের বাসস্থান নিশ্চিত করবে মালয়েশিয়া

জেসমিন পাপড়ি
2024.10.04
ঢাকা
বাংলাদেশি কর্মীদের বাসস্থান নিশ্চিত করবে মালয়েশিয়া ঢাকার হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সফররত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে (বামে) স্বাগত জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৪ অক্টোবর ২০২৪।
[সৌজন্যে: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং]

বাংলাদেশসহ বিদেশি কর্মীদের কাজের পাশাপাশি বাসস্থান নিশ্চিত করতে মালয়েশিয়া বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। শ্রমিকদের সাথে ‘আধুনিক দাসের’ মতো আচরণ মেনে নেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।

পাঁচ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন আনোয়ার ইব্রাহিম।

একইসঙ্গে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও মালয়েশিয়া যেতে না পারা প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁর দেশে নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানাননি আনোয়ার।

গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আনোয়ার ইব্রাহিম প্রথম বিদেশি সরকার প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ সফর করলেন।

মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে ‘সিন্ডিকেটের তৎপরতা’ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার বলেন, অতীতের পদ্ধতি ভেঙে এখন ‘স্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

“বাংলাদেশে কিংবা মালয়েশিয়া কোথাও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেই করুক, কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের শ্রমিক দরকার এবং তাদের প্রতি যেন ‘আধুনিক দাসের’ মতো আচরণ করা না হয়।”

তিনি বলেন, শ্রমিক নেবার “প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে। …“শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা এবং কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কেউ ঘটালে আমরা তাদের বাদ দিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছি এবং বাদও দিয়েছি।”

বাংলাদেশের জন্য ‘ইতিবাচক’

আনোয়ার ইব্রাহিম যে বক্তব্য দিয়েছেন তা খুবই ইতিবাচক বলে মনে করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম-এর সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বেনারকে বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের চাওয়াও একই। আমরা কর্মী পাঠাতে চাই, কিন্তু কোনো সিন্ডিকেট চাই না। আমরা চাই আমাদের শ্রমিকরা তাদের তাদের অধিকার নিয়ে সেখানে থাকবেন।”

শরিফুল হাসান বলেন, “আগে সকল নিয়োগকর্তা কর্মীদের বাসস্থান নিশ্চিত করত না। এখন যদি বাসস্থান বাধ্যতামূলক করা হয় নিঃসন্দেহে সেটা ভালো উদ্যোগ। এতে করে কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি পাবেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বড়ো সমস্যা হলো সিন্ডিকেট, যার সূত্রপাত হয় মালয়েশিয়া থেকে।”

“শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট ভেঙে, কর্মীদের কর্মসংস্থান ও আবাসন নিশ্চিত করাসহ প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম যদি তাঁর অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করেন, তাহলে সেটা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া দুই দেশের জন্যই বড়ো অর্জন হবে,” মনে করেন শরিফুল হাসান।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথম ধাপে তারা বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজার শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নজর দেবেন। সব শর্ত পূরণ করা থাকলে এই কর্মীরা নতুন করে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার হিসেবে মালয়েশিয়া শীর্ষস্থানীয় গন্তব্য। কিন্তু দেশটি শ্রমবাজারের শৃ্ঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত ৩০ মে বাংলাদেশিসহ বিদেশি নেওয়া বন্ধ করে। এর আগে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফ্লাইট জটিলতার কারণে ১৮ হাজার কর্মী দেশটিতে যেতে পারেনি।

শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আনুমানিক ৮ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্য প্রায় সাড়ে ৪ লাখই ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন।

বাংলাদেশে মালয়েশীয় কোম্পানি ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর সমস্যা দ্রুত সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তারা দুর্নীতি, সুশাসন ও অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে আপস করেন না।

বাংলাদেশের অষ্টম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা শিক্ষাসহ আরও বেশ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী।

BD-MY-labor2.JPG
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি নির্মাণক্ষেত্রের ডরমিটরিতে নিজের বিছানা তৈরি করছেন এক বাংলাদেশি শ্রমিক। ১৭ মার্চ ২০২২। [রয়টার্স]

মালয়েশিয়ায় মানবেতর অবস্থায় বাংলাদেশি কর্মীরা

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা বাংলাদেশি কর্মীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া গিয়ে তাদের কাজ জুটছে না, আবার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা দেশেও ফিরতে পারছে না।

মালয়েশিয়ার জোহর বাহরু থেকে গোপালগঞ্জ বাসিন্দা মাহাবুব মোল্লা (৪২) বেনারকে বলেন, “আমি ১৫ মাস ধরে মালয়েশিয়ায় আছি। আমার ভিসার মেয়াদ আগেই শেষ হয়ে গেছে। জানি না আর কতদিন এখানে আটকে থাকব।”

তিনি বলেন, “আমি পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে এখানে এসেছিলাম। সেই টাকা পরিশোধ না করে ফেরত যেতে পারব না। যদি আমি টাকা না নিয়ে ফিরে যাই, তারা আমাকে মেরে ফেলবে। এজেন্সি আমাকে একটি নির্মাণ কাজ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু আসার পরে আমাকে কোনো কাজই দেয়নি। কিছুই দেয়নি।”

এখন কোনো কাজ নেই জানিয়ে মাহাবুব মোল্লা বলেন, বাসা ভাড়া এবং খাবারের খরচ মেটাতে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। আমি জানি না আর কতদিন এভাবে চলতে পারব।

মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কর্মী অ্যান্ডি হল বেনারকে বলেন, এসব কর্মীকে মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হলেও কিছুই নিশ্চিত করা হয়নি। এটি তাদের জন্য একটি বড়ো আর্থিক আঘাত। এরা অনেকে টাকা ধার করে, তাদের গরু, জমি বিক্রি করেছে—শুধু মালয়েশিয়ায় আসার জন্য। এখন তারা নিঃস্ব।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা কামনা

বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রোহিঙ্গা সংকটকে একটি ‘তাজা টাইম বোমা’ অভিহিত করে এটি যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিয়েছেন।

আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের হাতে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। আমরা বিষয়টি উত্থাপন করতে থাকব। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। এটি এমন এক বিষয় যা আমাদের যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে হবে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন জানিয়ে ইউনূস বলেন, এটি মালয়েশিয়ার জন্যও এটি সমস্যা। সেখানে অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। আমাদের এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে এবং আমরা আসিয়ান, মালয়েশিয়ার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করব।

উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আসিয়ানের পরবর্তী চেয়ার হতে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকটের দুটি দিক তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, গত ৭ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বছরে গড়ে ৩২ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, কক্সবাজারে অবস্থিত আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা তরুণদের একটি পুরো নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এটি ক্ষুব্ধ তরুণদের একটি প্রজন্ম। তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি এই উদ্বেগের কথা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি।

“এই সমস্যার একটি আন্তর্জাতিক সমাধান খুঁজতে মালয়েশিয়া আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে,” বলেন তিনি।

বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসানচরে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করেছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মালয়েশিয়া থেকে ইমান মুত্তাকিন ইউসুফ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।