সুনামগঞ্জে গাছে বেঁধে সাংবাদিক নির্যাতন: মূল চার আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে
2021.02.03
ঢাকা
দুর্বৃত্তদের পৈশাচিক হামলার শিকার সুনামগঞ্জের সাংবাদিক কামাল হোসেন রাফি (৩৭) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার বেনারকে জানিয়েছেন, তাঁকে মারধর করা পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে চারজনই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি।
নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের তথ্য সংগ্রহ ও ভিডিও ধারণ করতে গেলে গত সোমবার তাঁকে গাছের সাথে বেঁধে মারধর করা হয়।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ঘাঘটিয়া গ্রামে ওই ঘটনার পর বুধবার পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যদিও কামাল জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মূল অপরাধী একজন।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা উপপরিদর্শক দীপঙ্কর বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের সব রকম চেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা করি খুব দ্রুতই সব অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হবে।”
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ফয়সল আহমদ (১৯), আনহারুল ইসলাম (২০), তাহের হোসেন (২০), মাসরিবুল ইসলাম (২৬) ও রইস উদ্দিনকে (৪০ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে মামলার দুই নম্বর আসামি রইস।
মামলায় আসামি হিসেবে মাহমুদ আলী শাহ (৩৮), দীন ইসলাম (৩৫), মুশাহিদ তালুকদার (৪৫) ও মনির উদ্দিন (৫২) ছাড়াও আরো পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলেও জানান দীপঙ্কর বিশ্বাস।
সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তারেক বেনারকে বলেন, “ওই ঘটনার যে ভিডিও আমাদের হাতে এসেছে, সেখানে দেখা যায়, কয়েকজন বয়স্ক লোকও কামালকে মারধর করছে। তবে তাদের কেউই গ্রেপ্তার হয়নি।”
অভিযুক্তরা সবাই ঘাঘটিয়া গ্রামের বাসিন্দা উল্লেখ করে আহত সাংবাদিক কামাল বেনারকে বলেন, “মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারাই আমার ওপর প্রথম হামলা করেছে। এদের মধ্যে মাহমুদের কাছে ধারালো অস্ত্র ছিল।”
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মাহমুদ দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন, “এলাকার গরিব-দিনমজুর লোকজন টুকরি দিয়ে বালু তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। কামাল গিয়ে তাঁদের কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন।”
এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শ্রমিকেরা কামালকে মারধর করেছে জানিয়ে মাহমুদ দাবি করেন, তিনি মারধরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
তবে এ প্রসঙ্গে বেনারের প্রশ্নের জবাবে চাঁদা দাবির অভিযোগ অস্বীকার করেন সাংবাদিক কামাল।
“মফস্বলে সাংবাদিকদের এভাবে মারধর করা বা এমন ঘটনায় আক্রান্ত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলার ঘটনা নতুন কিছু নয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন প্রবীণ সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “ঢাকার বাইরে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বরাবরই নাজুক। তবে সেখানে সাংবাদিকদের ভাবমূর্তিও খুব বেশি ভালো নয়। যে কারণে সেখানে ঝুঁকিটাও অনেক বেশি।”
সুনামগঞ্জের সাংবাদিক নেতা তারেক বলেন, “জেলার যাদুকাটা ছাড়াও ফাজিলপুর, ধোপাজানসহ ওই এলাকার মোট সাতটি বালু মহালের কোনোটিই সরকার এবার ইজারা দেয়নি। ফলে সেখান থেকে বালু উত্তোলন, বিক্রি ও পরিবহন অবৈধ। তবুও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে বালু উত্তোলন চলছে।”
গাছে বেঁধে নির্যাতন
কামাল জানান, যাদুকাটা নদীর তীর কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ শুনে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। সরেজমিনে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তিনি স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, “যেহেতু ঘটনাস্থলে গেছেন, দুটো ছবি এবং ঘটনার একটু ভিডিও করে নিয়ে আসেন।”
“তাঁর ফোন রেখে আমি ছবি নেই এবং ভিডিও শুরু করি। এর মধ্যে আবু লাহাব নামে এক ব্যক্তি এসে নিজেকে ওই জায়গার মালিক দাবি করে এবং ভিডিও করতে বাধা দেয়,” জানান কামাল।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “এরপর অদূরে থাকা অন্যরা এসে আমাকে জেরা শুরু করে, এক পর্যায়ে শুরু হয় মারধর। প্রথমে তারা আমাকে নদীর তীরে প্রায় আধঘণ্টা মারধর করে। তখন আমি জ্ঞান হারাই।”
“জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার হাত বাঁধা। এরপর সেখান থেকে চকবাজারে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে আরও নির্যাতন করে। তারা আমার প্যান্টশার্ট ছিঁড়ে ফেলে। ক্যামেরা, মোবাইল, মানিব্যাগ—সবকিছুই নিয়ে যায়,” বেনারকে জানান ওই সাংবাদিক।
ঘটনার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। মধ্যযুগীয় কায়দায় তাঁকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসনের টনক নড়ে।
এ ব্যাপারে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও অন্যায়।”
পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মফিজ উদ্দিনও সাংবাদিকদের বলেন, “দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
কামাল জানান, তাঁর মোটরসাইকেলটি উদ্ধার হওয়ার কথা শুনেছেন তিনি। কিন্তু ক্যামেরা ও মোবাইল এখনও পাননি।
সাংবাদিকতার সাথে ২০০৭ সাল থেকে যুক্ত কামাল দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক শুভ প্রতিদিনের তাহিরপুর উপজেলা প্রতিনিধি ও তাহিরপুর প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক।
জানুয়ারিতে নির্যাতনের ছয়টি ঘটনা
চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে (জানুয়ারি-২০২১) জানানো হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এই মাসে ছয়জন সাংবাদিক নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এর আগে মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০২০ নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত বছর সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ জন সাংবাদিক। আর এতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন।
এদিকে সুনামগঞ্জে নির্যাতনের ওই ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে সাংবাদিক সমাজ। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বুধবার মানববন্ধন করেছেন ঢাকায় কর্মরত সিলেট বিভাগের সাংবাদিকেরা।