ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক আটক, অভিযোগ ‘জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি’

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.29
ঢাকা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক আটক, অভিযোগ ‘জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি’ প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বামধারার ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদ কর্মসূচি। ২৯ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে দেশের ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির’ অভিযোগে দেশের অন্যতম সংবাদপত্র প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে বুধবার ভোরে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ(সিআইডি)।

বুধবার দুপুরের দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে জানান, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় ‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারের একটি অনুলিপি এসেছে বেনারের হাতে। মামলার বাদী ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় বসবাসকারী গোলাম কিবরিয়া। তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক।

তেজগাঁও থানায় বুধবার সোয়া দুইটায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(২), ২৬(২), ২৯(১), ৩১(২) ও ৩৫(২) ধারায় মামলাটি করা হয় বলে জানান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান

যেসব অভিযোগে মামলা

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৬ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েব সাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং সংবাদপত্রটির ফেসবুক পেজে এটি শেয়ার করা হয়।

এতে দেখা যায়, একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতি সৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদনে ওই শিশুর নাম জাকির হোসেন উল্লেখ করা হয়েছে। জাকির হোসেন বলেছেন, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম। বাজারে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”

প্রকাশের পরে প্রতিবেদনটি ছড়িয়ে পড়ে (ভাইরাল হয়) এবং এই ঘটনায় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সোনালি গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণসহ বহির্বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ও স্বাধীনতার অর্জন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশন তাদের সংবাদে উল্লেখ করে, প্রথম আলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি প্রচার করেছে। শিশুটির সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। নাম-পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিশুটির নাম সবুজ আহমেদ। সে স্কুল শেষে ফুল বিক্রি করে। কিন্তু তাকে জাকির হোসেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুটি ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম। বাজারে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ এমন মন্তব্য করেনি।

একাত্তর টেলিভিশনে আরও উল্লেখ করা হয়, শিশুটি জানিয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিক তাঁকে ১০ টাকা হাতে দিয়ে ওই ছবি তুলেছেন।

এজাহার অনুযায়ী, “এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন উদ্দেশ্যে একটি অশুভ চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এই মিথ্যা সংবাদ তৈরি ও পরিবেশন করে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।”

এই কারণে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন উল্লেখ করেছেন বাদী মো. গোলাম কিবরিয়া। তিনি শামসুজ্জামানসহ অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলার আবেদন করেন।

উল্লেখ্য, শামসুজ্জামান গুলশানের হোলি আর্টিজেন জঙ্গি হামলার সময় নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের ভাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাস করা এই তরুণ সাংবাদিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে সাভারে কাজ করেন।

বড়ো অপরাধ: ওবায়দুল কাদের

শামসুজ্জামানকে আটক করার বিষয়ে কিছু জানেন না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বড়ো অপরাধ।

বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল বলেন, “নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতার অর্থ বোঝাচ্ছে। চাল, ডাল, তেলের স্বাধীনতা। সেই বাচ্চার এসব বলার কি বিচার-বুদ্ধি হয়েছে? তার নামে এই খবর প্রচার করে ভাইরাল করা হলো। এটা তো আমরা দেখছি, এগুলো কি জার্নালিজম! কী রকম মিথ্যা। ছেলের নাম সবুজ, তাকে বানানো হলো জাকির হোসেন। ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হলো দিনমজুর। এটা কোন সাংবাদিকতা! এই সাংবাদিকতাটাও আমাদের দেশে মিডিয়াকে পরিহার করতে হবে।”

আইনি পথে লড়ব: প্রথম আলো

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ‘আমরা দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি’ করতে এই সংবাদ পরিবেশন করেছি। এটা একদম ঠিক নয়। কারণ আমাদের ঘোষিত নীতি হলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এটি নিয়ে বিতর্ক করার কোনো কারণ নেই।”

“দ্বিতীয় কথা হলো, শামসুজ্জামান প্রতিবেদন করেছেন এবং সেখানে দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্বৃতি দিয়েছেন। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে ব্যবহার করা উদ্ধৃতি থেকে আমাদের পত্রিকার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিসহ একটি কার্ড প্রকাশিত হয়। তাতে ফুল বিক্রেতা একটি শিশুর ছবির নিচে দিনমজুর জাকির হোসেনের বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে ছবি এবং ব্যক্তির উদ্ধৃতির মধ্যে গরমিল হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

সাজ্জাদ শরীফ আরও বলেন, “এটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুক্ষণ পর বিষয়টি আমাদের নজরে আসে এবং আমরা আধা ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে সেটি সরিয়ে ফেলি। সংবাদপত্রের চর্চার অংশ হিসেবে নিচে এ ব্যাপারে সংশোধনী দেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “সংবাদ পরিবেশন সম্পর্কে কোনো সমস্যা হলে দেশে প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। বিষয়টি সুরাহার জন্য সেখানে না গিয়ে রাতের আঁধারে তাঁকে (প্রতিবেদক) গ্রেপ্তার করা হলো। শামসুজ্জামান তো চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী নয়! কিন্তু তাঁকে এভাবে গ্রেপ্তার করা হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হলো। এটি দুঃখজনক।”

সাজ্জাদ শরীফ বলেন, “যেহেতু তাঁকে আটক করা হয়েছে, সেহেতু আমরা বিষয়টি সুরাহার জন্য আইনি পথেই লড়ব।”

যা বললেন বিএনপি মহাসচিব

বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এটা ভয়াবহ ঘটনা। ওই সাংবাদিক কী অপরাধটা করেছেন? আমি তো বুঝলাম না। সত্য যে ঘটনা, সেটা তিনি তুলে ধরেছেন। একজন মানুষের যে উক্তি, সে উক্তি তুলে ধরেছেন।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “অপরাধটা কী, ২৬ মার্চের দিনেই এটা করাটা? তার মানে স্বাধীনতাকে অপমান করা হয়েছে, মানহানি করা হয়েছে? তো একটা মানুষ যদি স্বাধীনতার দিনে ক্ষুধার্ত বোধ করে, বঞ্চিত বোধ করে এবং সে যদি ওই কমেন্টটা দেয় যে—দেশ স্বাধীন হয়ে আমার কী লাভ হলো, অপরাধটা কোথায়?’

উদ্বেগ, মুক্তি দাবি

শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের এবং তাঁকে আটকের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এডিটরস গিল্ড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্রুত সংশোধন, সাংবাদিক শামসুজ্জামানসহ সব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং এই আইনে কেউ গ্রেপ্তার বা আটক থাকলে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেছে সম্পাদক পরিষদ।

গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, একজন সাংবাদিকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাশাপাশি এ ধরনের আচরণ স্বাধীন সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা।

শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা।

গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরাও।বিকেল সোয়া ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।