প্রথম আলো সম্পাদকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা
2023.03.30
ঢাকা
রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর কারাগারে পাঠানোর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান।
সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা এবং প্রতিবেদককে জেলে পাঠানোর ঘটনায় বৃহস্পতিবার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশে-বিদেশী বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
বৃহস্পতিবার শামসুজ্জামানকে আদালতে উপস্থাপন করা হলে তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন।
প্রথম আলোর আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, শামসুজ্জামানের নামে তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা প্রথম মামলার ব্যাপারে পুলিশ আদালতে কোনো ফরোয়ার্ডিং না দেয়ায় “ওই মামলা নিয়ে কিছু ব্যবস্থা নেয়নি আদালত।”
“তবে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় শামসুজ্জামানকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আমরা তাঁর জামিন আবেদন করেছিলাম কিন্তু আদালত নাকচ করে কারাগারে প্রেরণ করেছেন,” বলেন প্রশান্ত কুমার।
“মামলার প্রধান আসামি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে পলাতক বলে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে,” বলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে করে শামসুজ্জামানকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল মালেক মশিউরের দায়ের করা ওই মামলায় মতিউর রহমান ও শামসুজ্জামানের সাথে প্রতিবেদকের সহকারী ক্যামেরাপারসন এবং অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
বুধবার রাত ১১টা ১০ মিনিটে তিনি রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা নেয় তেজগাঁও থানা পুলিশ। মামলাটি দায়ের করেন সরকারি দলের নেতা মো. গোলাম কিবরিয়া।
বুধবার ভোরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে শামসুজ্জামানকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করতে “সঠিক প্রক্রিয়া রক্ষা করা হয়নি,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “শামসুজ্জামানকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি আইনের লঙ্ঘন এবং এই কাজে জড়িতদের জবাবদিহি করা দরকার।”
এদিকে একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে “সংক্ষুব্ধ” ব্যক্তিদের করা “মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” বলে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন, “পুলিশের তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে এবং আইনের গতিতে আইন চলবে।”
নতুন মামলায় যা বলা হয়েছে
আব্দুল মালেক মশিউর মালেক অভিযোগ এনেছেন যে, ২৬ মার্চ তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করার সময় ছড়িয়ে পড়া (ভাইরাল) একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখেন। তাতে তিনি দেখতে পান প্রথম আলোর প্রতিবেদক শামসুজ্জামান একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন যার শিরোনাম ছিল “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবে।” প্রতিবেদনের নিচে লেখা জাকির হোসেন, দিনমজুর, সাভার।
তিনি ২৭ মার্চ একাত্তর টিভির এক প্রতিবেদনে জানতে পারেন যে, কথিত জাকির নামে শিশুটির নাম সবুজ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুটিকে ১০ টাকা দিয়ে তার ছবি তোলা হয়েছে এবং শিশুটি প্রথম আলোর কাছে কোনো বক্তব্য দেয়নি, উল্লেখ করা হয় এজাহারে।
আরও উল্লেখ করা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদক শামসুজ্জামান ও সম্পাদক দেশের মহান স্বাধীনতা সম্পর্কে জনমনে বীতশ্রদ্ধ সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বর্তমান শান্তিময় পরিস্থিতি বিঘ্নিত করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করাসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার হীন চেষ্টা করেছেন। এর ফলে দেশের জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
নিন্দা ও প্রতিবাদ
প্রথম আলো সম্পাদক ও প্রতিবেদকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করার নিন্দা জানিয়েছে কূটনৈতিক মহল। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের উদ্যোগে গঠিত মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, তারা “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, ভয়-ভীতি প্রদর্শনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিষয়ে উদ্বিগ্ন।”
ভয়-ভীতি প্রদর্শনের ঘটনার উদাহরণ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, আল-জাজিরার লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিকের ভাইয়ের ওপর হামলা, ঢাকা ট্রিবিউনের আলোকচিত্রীর ওপর হামলা এবং সম্প্রতি প্রথম আলোর সাংবাদিক আটকের ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছে কোয়ালিশন। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জানায়, এই মামলা দেশের গণমাধ্যমকে শায়েস্তা করতেই করা হয়েছে।
শামসুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে গভীর রাতে তুলে নেওয়া, ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
সংস্থাটি মনে করে, এই ঘটনায় একজন সাংবাদিক, দেশের একজন নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের এবং প্রয়োজনে শায়েস্তা করার ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি করেছে।
বৃহস্পতিবার দেওয়া বিবৃতিতে আর্টিকেল নাইনটিন-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এ মামলা আইনকে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ। এটি দেশের মিডিয়া সংশ্লিষ্ট সবার জন্য হুমকি ও ভয়ের স্পষ্ট সংকেত।”
আর্টিকেল নাইনটিন মনে করছে, এই ধরনের আচরণ জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আর্টিকেল নাইনটিন, সম্পাদক মতিউর রহমানের নামে মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা প্রয়োগ তাঁকে হয়রানি করা ও তাঁর পত্রিকার সাহসী সাংবাদিকতাকে “ভয় দেখানোর সমান” বলে মনে করে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ এ কথা বলেন।
সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস ও দৈনিক যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার মাহবুবুল আলম বাবলুর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাসহ এই আইনে সংবাদকর্মীদের নামে যতগুলো মামলা হয়েছে, অবিলম্বে সেসব মামলা প্রত্যাহার করার বিষয়ে পুনরায় দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। বৃহস্পতিবার সংগঠনটির পক্ষে সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এক বিবৃতিতে এ দাবি জানায়।