করোনাভাইরাস সংকটকালে অনেকগুলো ওয়েবসাইট বন্ধ করল বাংলাদেশ

বেনারনিউজ স্টাফ
2020.04.02
ওয়াশিংটন ডিসি
200402-BD-soldiers-1000.jpg করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় জনসমাগম এড়াতে সরকার ঘোষিত বাধ্যতামূলক সাধারণ ছুটিতে ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর টহল। ২৬ মার্চ ২০২০।
[এএফপি]

করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রান্ত গুজব ছড়ানোর দায়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান ঘোষণার দুই দিন পর বাংলাদেশে অনেকগুলো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানিয়েছেন সরকারের একজন মন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশের পাঠকরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক সহায়তায় প্রকাশিত বেনারনিউজের ইংরেজি ও বাংলা কোনো সাইটই দেখতে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। তবে সম্প্রতি বন্ধ করা ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে বেনারনিউজ রয়েছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানাননি বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

কঠোরভাবে সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে ‘সঠিক সংবাদ ও তথ্য’ প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বেনারনিউজ ওয়েবসাইট ব্লক করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

বেনারনিউজ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত বেসরকারি ও অলাভজনক সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা এশিয়ার পাঠকদের জন্য সেন্সরবিহীন তথ্য ও সংবাদ পরিবেশন করে থাকে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার কৌশল নিয়ে সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোরতা প্রদর্শন করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চলতি সপ্তাহের সমালোচনার পরপরই এই ওয়েবসাইট বন্ধের বিষয়টি ঘটল।

স্থানীয় এক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন মতে, ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সরকারের করোনাভাইরাস রোগ নির্ণয়ের জন্য নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ প্রায় সর্বনিম্ন।

বেনারনিউজের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাঁর মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে।

তবে ওই সাইটগুলোর মধ্যে বেনারনিউজ রয়েছে কি না সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

“আমি আসলে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না বেনারনিউজ বন্ধ করা সাইটের তালিকায় আছে কি না,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “আমার ঠিক স্মরণ নেই যে বন্ধ করা ওয়েবসাইটের তালিকার মধ্যে বেনারনিউজ আছে কি না।”

“সাইটের নাম মনে রাখা একজন মন্ত্রীর কাজ না,” উল্লেখ করে তিনি বলেন “আমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেসকল সাইট বন্ধ করতে বলে, সেগুলোই বন্ধ করা হয়। আপনারা বরং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করুন।”

করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ৫০টি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বিটিআরসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় পুলিশ সদরদপ্তর।

এছাড়া সামাজিক মাধ্যমের আরো ৮২টি অ্যাকাউন্ট, পেইজ ও সাইটে গুজব ছড়ানোর পেছনের মানুষদের খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান চলছে বলেও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।

গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ঢাকা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও কিশোরগঞ্জ থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, গুজবের সাথে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত থাকবে।

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারিভাবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ছয়জনের মৃত্যু ও ৫৬ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, দেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা হয়ত অনেক বেশি।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারে বলে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের একটি খসড়া নথিতে আশঙ্কা করা হয়।

সুইডেন ভিত্তিক নিউজপোর্টাল নেত্রনিউজ জাতিসংঘের ‘কান্ট্রি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্লান’ শীর্ষক ফাঁস হওয়া ওই নথিটির ওপর ভিত্তি করে গত শনিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ওই নথিটি তৈরি করেছে বলে নেত্র নিউজকে জানান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা অফিসের প্রধান বর্দান জাং রানা।

খসড়া ওই নথিটি গত সপ্তায় ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানায় নেত্র নিউজ।

ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার বেনারনিউজও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের ওই নথিটি দেখেছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তবে এ ধরনের নথি প্রকাশ করা জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বেনারকে বলেন, “এ ধরনের নথি প্রকাশ করা জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। আইনানুযায়ী, জাতিসংঘ এরকম কোনো নথি প্রচার করার আগে আমাদের সরকারের সাথে আলোচনা করার কথা। আমরা সম্মতি দিলে তবেই তারা প্রচার বা বিতরণ করতে পারে।”

এদিকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের কৌশল নিয়ে সমালোচনা করার দায়ে ডাক্তার, বিরোধী দলীয় সদস্য ও ছাত্রসহ অন্তত এক ডজন মানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বিবৃতিতে সংস্থাটির এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হলে তা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের রয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, যারা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবেন অথবা এই সংকট মোকাবেলার ব্যাপারে সরকারের কৌশল নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন তাঁদের স্তব্ধ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এই অবস্থায় সরকারের উচিত মানুষের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব না করে বরং এই ভাইরাস প্রতিরোধ, দমন ও এর চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা জানিয়ে জনগণকে আশস্ত করা।”

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “আমরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করি। সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যস্ত। কারো মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।