ডিজিটাল নিরাপত্তার মামলা থেকে অব্যাহতির পর জামালপুরে খুন হলেন সাংবাদিক
2023.06.15
ঢাকা

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরপরই দুর্বৃত্তদের হামলায় জামালপুরে এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আক্রান্ত সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম (৪২)। নাদিম বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন।
গত ১৪ মে নাদিমসহ দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন স্থানীয় সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলম বাবু। মামলাটি বুধবার আদালতে খারিজ হয়ে যায়।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ও নাদিমের সহকর্মী আল মুজাহিদ দাবি করেন, হামলার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং মাহমুদ আলম বাবুকে গলির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন।
নিহতের স্বজনেরা হামলার জন্য মাহমুদ আলম বাবুকে দায়ী করেছেন।
নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “ওই চেয়ারম্যান আগেও নানাভাবে নাদিমকে হেনস্তার চেষ্টা করেছেন।”
এ ব্যাপারে জানতে বাবুর মোবাইল নম্বরে বারবার কল করেও সংযোগ পায়নি বেনার।
জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ জানান, সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
সংবাদ প্রকাশের জেরে ১১ এপ্রিল রাতেও হামলা শিকার হয়েছিলেন নিহত নাদিম।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল বাতেন বলেন, “তিনি মাথায় আঘাত নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছিলেন। অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। অস্ত্রোপচারের আগেই মারা যান।”
চেয়ারম্যান পলাতক, আটক ৩
নাদিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনকে আটক এবং “আরও চার-পাঁচ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে,” বলে বেনারকে জানিয়েছেন বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানা।
বাকিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হওয়ায় জড়িতরা গা ঢাকা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা আছে।”
তবে নাদিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “এখনো পরিবারের কেউ আসেনি। এখনো লিখিত অভিযোগ করেনি।”
মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ
সাংবাদিক নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, এমনকি হত্যার ঘটনা সম্প্রতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।”
হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিবৃতিতে বলা হয়, “নিহত সাংবাদিক গোলাম রাব্বানীর স্ত্রীর বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আগেও তিনি নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজনই হামলা করে তাঁকে হত্যা করেছেন।”
বছরের প্রথম সাংবাদিক খুন
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০১ জন সাংবাদিক। তবে কোনো খুনের ঘটনা ঘটেনি।
সেই হিসেবে নাদিম হত্যাকাণ্ডই চলতি বছর বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক হত্যার প্রথম ঘটনা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসেবে গত বছরে দেশে সাংবাদিক খুন ও অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৯টি। এর মধ্যে চারটি ঢাকায় এবং বাকিগুলো ঢাকার বাইরে।
বাংলাদেশে ক্রমাগত সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গণমাধ্যমের ওপর হুমকি, হামলা ও কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ নিয়ে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে এক বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
একইসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার এবং মামলার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও উল্লেখ করেন।
প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি আইনটি বাতিলের আহ্বান জানানো হয়।
“সাংবাদিকদের মারা এখন সবচেয়ে সহজ, কারণ সাংবাদিকদের মারলে তার বিচার হয় না,” বেনারকে বলেন সাংবাদিক নেতা ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ।