অননুমোদিত নিউজ পোর্টাল বন্ধ করতে এক সপ্তাহের সময় দিলো আদালত
2021.09.14
ঢাকা
অনুমোদন ছাড়াই চলছে—এমন অনলাইন ওয়েবপোর্টালগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গত জুনে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের শুনানিতে মঙ্গলবার এই আদেশ দেয়া হয়।
তবে “আনুষ্ঠানিকভাবে এ সংক্রান্ত আদেশ এখনো আমরা হাতে পাইনি,” জানিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) উপ-পরিচালক (গণমাধ্যম) জাকির হোসেন খান বেনারকে বলেন, “আদালতের লিখিত নির্দেশনা দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এর আগেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে বিটিআরসি ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আদেশ পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এগুলো বন্ধ করে বিবাদীদের প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত।”
রিট আবেদনে সংযুক্ত একটি ইংরেজি পত্রিকার সংবাদের অনুলিপিতে ৯২টি গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটের অনুমোদন থাকার কথা উল্লেখ করে আইনজীবী জারিন রহমান বেনারকে জানান, আদালত ওই ৯২টির কথা উল্লেখ করে আদেশ দিয়েছে।
তবে এর বাইরে অনুমোদিত বা নিবন্ধনের জন্য বিবেচনাধীন কোনো অনলাইন সংবাদমাধ্যম থাকতে পারে বলে তাঁরা আদালতকে জানিয়েছেন।
“মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর আদালত এ ব্যাপারে পরবর্তী আদেশ দেবেন,” যোগ করেন এই আইনজীবী।
২০১৯ সালের ১৫ জুলাই নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিনে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, আট হাজারেরও বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টালের আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ নভেম্বর ৫১টি নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য অনুমোদন দিয়ে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে মন্ত্রণালয়।
একই বছরের জুলাইয়ে ৩৪টি পোর্টাল এবং সেপ্টেম্বরে ৯২টি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জানান, আরো কিছু অনলাইনের নিবন্ধন দেওয়ার পর অনিবন্ধিত সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে সরকার।
আদালতের এই আদেশ ‘অনভিপ্রেত’ উল্লেখ করে বিএনপি সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলে সেটা জাতির জন্য ভয়ংকর বিষয় হবে।”
যেভাবে এসেছে এই আদেশ
ঢাকার গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও চ্যানেলে মানহানিকর খবর প্রকাশ বন্ধে গত জুন মাসে দুই আইনজীবী রাশিদা ও জারিনের করা রিট আবেদনের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার এই আদেশ এলো বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. কামরুল হোসেন মোল্লার ভার্চুয়াল বেঞ্চ থেকে।
এর আগে রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর গত ১৬ আগস্ট রুল দিয়েছিল হাইকোর্ট। অননুমোদিত ও অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রচার-প্রকাশ বন্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে এবং নিবন্ধনের জন্য বিবেচনাধীন অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে নিবন্ধন দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে ওই রুলে।
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আদালত রুলের কোনো জবাব না পাওয়ায় সম্পূরক আবেদন করে অনিবন্ধিত, অনুমোদিত নিউজপোর্টাল বন্ধের আরজি জানান আইনজীবীরা।
আইনজীবী জারিনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ৫ মে সংবেদনশীল সংবাদসহ যে কোনো খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য ‘নৈতিক নীতিমালা’ চেয়ে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিআরসি চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে এই নোটিশ দেওয়া হয়। সেই নোটিশের কোনো জবাব না পেয়েই হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন তাঁরা।
রিট আবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি রাজধানীতে ২১ বছরের এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনের ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে বিশেষ করে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে অগ্রহণযোগ্যভাবে নিউজ পরিবেশন করা হয়েছে। অথচ এসব সংবাদ পরিবেশনা বন্ধে বিটিআরসি কিংবা প্রেস কাউন্সিল কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নৈতিক নীতিমালা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে দেশে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো চালু থাকার পরেও বিটিআরসি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাই এসব পোর্টালের রেজিস্ট্রেশনও জরুরি।
আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি
বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক রোকমুনুর জামান রনি বেনারকে বলেন, “গত আগস্ট থেকেই এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলাম আমরা। আদালত কী বলে তা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন যেহেতু একটি আদেশ এসেছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে মঙ্গলবার রাতে জরুরি সভা ডাকা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে আগামী সপ্তাহেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
তাঁদের সংগঠনের সহস্রাধিক সদস্যের মধ্যে মাত্র আট-নয়জনের অনলাইন অনুমোদন পেয়েছে উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, “আমাদের ৯০ শতাংশ সদস্যের আবেদনই বিবেচনাধীন অবস্থায় রয়েছে। অনেকের তদন্ত প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে।”
স্বাধীন বাংলা নিউজ ও দিনাজপুর নিউজ টুয়েন্টিফোর নামের দুটি সংবাদমাধ্যমের উদ্যোক্তা রনি জানান, “এই দুটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনও বিবেচনাধীন রয়েছে। এখন এগুলো বন্ধ করে দিলে তারা তদন্ত বা যাচাই-বাছাই করবে কীভাবে?”
“জানা মতে, আবেদিত ছয়শ প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ছাড়পত্র পেয়েছে,” বলে বেনারকে জানান গত মাসে যাত্রা শুরু করা নিবন্ধিত অনলাইন নিউজপোর্টাল মালিকদের সংগঠন অনলাইন নিউজপোর্টাল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ওএনএবি) সাধারণ সম্পাদক এবং এবিনিউজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকমের সম্পাদক শাহীন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “বাছাইকৃতদের কাউকে অনুমোদন দেওয়ার আগেই যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”
এ বিষয়ে তাঁরা আগামী সপ্তাহে মন্ত্রীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করি, মন্ত্রণালয় আদালতকে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হবে।”
এদিকে আদালতের এই আদেশের ফলে অসংখ্য গণমাধ্যম মালিকের বিনিয়োগ এবং কর্মীদের জীবিকা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতা কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “সরকার সমর্থক অনলাইন মালিকেরাই শুধু নিবন্ধন পাচ্ছে, এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হচ্ছে না। আমরা আশা করব আদালত গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠবে না।”
উল্লেখ্য, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া চালু করতে সরকারের অনুমতি লাগলেও ইন্টারনেট ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল চালু করতে এতদিন বিধিনিষেধ ছিল না।