নির্বাসিত সাংবাদিকের দাবি: তাঁর প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় বোন গ্রেপ্তার

বেনার স্টাফ
2021.10.08
ওয়াশিংটন ডিসি
নির্বাসিত সাংবাদিকের দাবি: তাঁর প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় বোন গ্রেপ্তার বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউটিউব পেজ পরিচালনা করেন সাংবাদিক কনক সরওয়ার। ৮ অক্টোবর ২০২১।
[ইউটিউব পেজের স্ক্রিনশট]

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিতএক বাংলাদেশি সাংবাদিকের সরকারের সমালোচনা করার ‘প্রতিক্রিয়ায়’ ঢাকায় গ্রেপ্তার তাঁর বোনের মুক্তির দাবি জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।

গত সোমবার দিবাগত রাতে সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকার ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এ সময় রাকার কাছে মাদক পাওয়া গেছে বলে দাবি করে র‍্যাব।

“আমি নিশ্চিত আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই আমার বোনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র‍্যাবের বিবৃতিতেও তাকে আমার বোন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাকে একটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া তাকে গ্রেপ্তারের আর কোনো কারণ থাকতে পারে না,” শুক্রবার টেলিফোনে বেনারকে বলেন কনক সরওয়ার।

তিনি বলেন, “আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় আমার কয়েকটি অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়াতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওইসব অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ফিনল্যান্ডে ব্যক্তিগত ভ্রমণ এবং জাতিসংঘে বিশাল দল নিয়ে আসার সমালোচনা ছিল।” 

র‍্যাব রাকাকে গ্রেপ্তার করার সময় তাঁর ১৭, ১৪ ও সাত বছর বয়সের তিন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকেও নিয়ে যায় বলে জানান কনক। প্রায় ৩০ ঘণ্টা র‍্যাব অফিসে আটকে রেখে পরে উকিলের জিম্মায় শিশুদের ছেড়ে দেয়া হয় জানিয়ে কনক বলেন, “ছোট ছেলেটা এখনো সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।”

তাঁর বোনের স্বামী প্রবাসে থাকেন জানিয়ে কনক জানান, শিশুরা এখন এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছে। 

এখনো চলমান রাকার পাঁচ দিনের রিমান্ড রোববার শেষ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেদিন জামিন আবেদন করা হবে, তবে জামিন দেয়া না দেয়া নির্ভর করে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।”

Nusrat Shahrin Raka.jpg
নুসরাত শাহরিন রাকা। ফাইল ছবি। [সৌজন্যে: কনক সরওয়ার]

‘বিচার চাইতে গিয়ে আসামি’

গ্রেপ্তারের পর রাকা “রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারকারী ও ষড়যন্ত্রকারী চক্রের একজন সদস্য” জানিয়ে বিবৃতিতে র‍্যাব জানায়, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে “দেশর শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন।”

“বিদেশে অবস্থানরত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারকারীদের মধ্যে অন্যতম, দেশদ্রোহী কনক সারোয়ার,” সম্পর্কে রাকার ভাই বলেও উল্লেখ করা হয় র‍্যাবের বিবৃতিতে।

মাদক মামলা দায়েরের পরবর্তীতে রাকার বিরুদ্ধে পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও একটি মামলা দায়ের করে।

“সে (রাকা) এখন পর্যন্ত আমার কোনো অনুষ্ঠান দেখেছি কি না সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সে সক্রিয় নয়। সংসার আর তিন বাচ্চা নিয়েই সে সব সময় ব্যস্ত থাকে,” বলেন কনক।

তিনি জানান, একটা পর্যায়ে রাকা জানতে পারেন যে, তাঁর নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সরকার বিরোধী পোস্ট করা হচ্ছে। সেটি জানার পর তিনি উত্তরা থানায় গিয়ে গত ১ অক্টোবর সেই ফেসবুক আইডির লিংকসহ সাধারণ ডায়রি করেন।

কিন্তু পরবর্তীতে এই ফেসবুক আইডির জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

“বিচার চাইতে গিয়ে উল্টা মামলার আসামি, এই হলো পরিস্থিতি,” বলেন কনক।

র‍্যাব তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে কনক বলেন, “সরকারের সমালোচনা কীভাবে রাষ্ট্রবিরোধিতা হয়? আমি সরকারের সমালোচনা করি, রাষ্ট্রের নয়। সরকার জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে, জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়, মানবাধিকার কেড়ে নেয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। এসবের সমালোচনা করা তো রাষ্ট্রবিরোধিতা না।”

কনক ১৯৯৫ সাল থেকে দৈনিক আজকের কাগজ ও জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার পর ২০০৫ সালে চ্যানেল আই দিয়ে শুরু করেন টিভি সাংবাদিকতা। পরবর্তীতে তিনি একুশে টিভিতে যোগ দিয়ে কাজ করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। 

কনক জানান, ওই বছর ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপির “গণতন্ত্র হত্যা দিবস” উদযাপন উপলক্ষে লন্ডন থেকে এক ভাষণ দেন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান। ভাষণটি সংবাদের ভেতর সরাসরি সম্প্রচার করে ইটিভি।

“ওটা প্রকাশের পরদিন ইটিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম গ্রেপ্তার হন। আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় ৩ মার্চ। বলা হয় তারেক রহমানের ভাষণ প্রচারের মাধ্যমে আমরা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।”

গ্রেপ্তারের পর তাঁর নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয় জানিয়ে কনক বলেন, “৫ দিন রিমান্ডে ছিলাম, নয় মাস জেলে ছিলাম। ওই সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।”

পরবর্তীতে ২০১৫ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে মালয়েশিয়া হয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন বলে জানান কনক।

বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কে বসবাস করে ‘কনক সরওয়ার নিউজ’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন।

“আমি মূলত বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, দুর্নীতি এবং সুশাসন এর মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি প্রোগ্রাম হোস্ট করি, এসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগী ছাড়াও সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করেন।”

“বাংলাদেশে যেহেতু প্রচলিত মিডিয়া কোনো কথা বলছে না, তখন বিকল্প হিসবে সামাজিক মাধ্যমকে আমাদের বেছে নিতে হয়। কারণ, কোনো না কোনো মাধ্যম থেকে তো তথ্য সামনে আনতেই হবে। মানুষকে তো জানাতেই হবে। এই কারণেই আমি ইউটিউব মাধ্যম ব্যবহার করি,” যোগ করেন কনক।

এদিকে নির্বাসিত সাংবাদিক কনককে শাস্তি দেবার নামে তার বোনকে গ্রেপ্তার করে “নিষ্ঠুর ও বর্বর” উপায়ে “প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা’ লজ্জাজনক হিসেবে মন্তব্য করে বিবৃতিতে রাকার মুক্তি দাবি করেছে সিপিজে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।