দাবি আদায়ে চিকিৎসকদের চেম্বার বন্ধ, রোগীদের দুর্ভোগ
2023.07.17
ঢাকা
ঢাকার গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ নবজাতক ও তার মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের মামলায় গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসকের মুক্তির দাবিতে বেসরকারি চেম্বারগুলোতে রোগী দেখা বন্ধ করেছেন চিকিৎসকেরা।
সোমবার থেকে শুরু হওয়া দুই দিনের এই কর্মসূচির কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা।
গত ৯ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রসব ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর এক মা ও নবজাতকের ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহা নামে দুজন কনিষ্ঠ ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিউটি ডাক্তার বা সহকারী ডাক্তার হিসেবে তাঁরা মূলত ঘটনার শিকার বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
এর প্রতিবাদে রোগী না দেখা কর্মসূচির ডাক দেয় অবস্টেট্রিক্যাল ও গাইনোকলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। পরে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন এতে সমর্থন দেয়।
দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এমন পরিস্থিতি সমর্থন করেন না বলে বেনারকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত রাখা বা জিম্মি করা অন্যায়।”
তবে তিনি বলেন, “ভুল হতে পারে, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ডাক্তার রোগীকে মারতে চান না। তদন্ত না করে, অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে কোনো ডাক্তারকে এভাবে আটকে রাখা অযৌক্তিক।”
এসব কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন ইমারজেন্সি রোগী এলে কেউ ভর্তি করতে চাচ্ছে না, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সিকিউরিটির কারণে ডাক্তাররা ভয় পাবে। এতে রোগীর ভোগান্তি বাড়বে।”
তাঁর মতে, ডাক্তার ও রোগীকে মুখোমুখি অবস্থানে নেওয়া ঠিক হবে না।
ওবিএসবি’র সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বেনারকে বলেন, “আমরা নানাভাবে অনুরোধ জানিয়েছি। শেষমেষ এ ধরনের কর্মসূচি ছাড়া উপায়ও ছিল না।”
“সোমবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সব চেম্বার বন্ধ ছিল। মঙ্গলবারও চেম্বার বন্ধ থাকবে। এরপর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে,” যোগ করেন তিনি।
ফারহানা দেওয়ান বলেন, “কেবল গাইনি নয়, সার্জারি, মেডিসিনসহ অন্য বিভাগের ডাক্তাররাও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। সব চেম্বার বন্ধ রাখা হয়েছে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আইনের আওতায় সবাইকে আনতে হবে। কিন্তু কাউকে আইনের আওতায় আনা হলে মানুষের স্বাস্থ্য সেবার অধিকার জিম্মি করা অগ্রহণযোগ্য।”
দেশে সরকারি স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের হাসপাতালে অনিয়মের খবর প্রায়েই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ গত ২৫ জুন রাজধানীর অতি পরিচিত হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় টিআইবি জানায়, সেখানে একচ্ছত্র ক্ষমতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়মের কারণে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী।
চিকিৎসকদের সুরক্ষায় আইন দাবি
আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁরা সুরক্ষা আইন চান।
অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, “আমাদের দুটি দাবি। একটি হলো কোনো তদন্ত ছাড়া একজন ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। আর স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন (মূলত ডাক্তারদের সুরক্ষা) প্রণয়ন চাই।”
হাসপাতালগুলোর মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার মনোভাব বা ভুল চিকিৎসার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “রোগীর কথায় ‘ভুল চিকিৎসা’ বলা ঠিক হবে না।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অতি মুনাফার মানসিকতায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি।
তবে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মানুষকে জিম্মি করা দেশের স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক সুশাসনের ইঙ্গিত দেয় না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বেনারকে বলেন, “সামগ্রিকভাবে সুশাসনের ঘাটতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।”
তিনি বলেন, “সরকারি হাসপাতালের সেবার অপ্রতুলতার কারণে বেসরকারি খাতের হাসপাতালগুলো সেবা দিচ্ছে, নইলে মানুষ কোথায় যেত। কিন্তু এখানে কেউ কেউ এই ব্যবস্থাকে মুনাফার তৈরির হাতিয়ার করেছেন।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে যেসব অনিয়ম সেখানে কেবল ডাক্তারই নন, হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে যারা ব্যবসা করছেন, তাদের দায় আরও বেশি।”
“অনেক সময় কোনো কোনো ডাক্তার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি হয়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন,” যোগ করেন তিনি।
তবে অর্থনীতিবিদ ও স্বাস্থ্য খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্বিকভাবে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্য সেবার চেয়ে অতি মুনাফার প্রবণতা বেড়েছে।
সরকারের হিসাবে গত এক দশকে স্বাস্থ্য সেবায় মোট ব্যয় বেড়েছে, অথচ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল তা কমিয়ে আনা। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে স্বাস্থ্য সেবার ব্যয়ের মধ্যে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে, যা ২০১২ সালে ছিল ৬২ শতাংশ।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে যা ঘটেছিল
মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতক মারা যাওয়ার পর সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা একে অপরকে দায়ী করে আসছেন।
আঁখির চিকিৎসায় নিজেদের গাফিলতির কথা স্বীকার ও ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল। হাসপাতালটির সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. এটিএম নজরুল ইসলাম ১৯ জুন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাফিলতির প্রথমেই আছেন হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহা। তার কারণেই আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
এর জবাবে সংবাদ সম্মেলন করে ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, আঁখিকে যখন ভর্তি করা হয়, তখন তিনি হাসপাতালে ছিলেন না। তাঁকে না জানিয়েই তাঁর (সংযুক্তা সাহা) কথা বলে ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ জুন আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ১৪ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে তার স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা যায় তাদের নবজাতক।
ঘটনার পর পার্শ্ববর্তী ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আঁখিও ১৮ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
নবজাতকের মৃত্যুর পর গত ১৪ জুন ধানমন্ডি থানায় ছয় জনের নাম উল্লেখসহ ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র মামলা দায়ের করেন ইয়াকুব। দুজন কনিষ্ঠ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন ছাড়া ১৩ বছর চিকিৎসা দিচ্ছিলেন চিকিৎসক সংযুক্ত সাহা। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, আগেই নিবন্ধন নবায়ন করানো উচিত ছিল। তিনি সময় পাননি।
রোগীদের কাছ থেকে নরমাল ডেলিভারির জন্য ৭০ হাজার টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে সংযুক্তা সাহা বলেন, তিনি ২২-৩০ হাজার টাকা নেন, বাকি টাকা পায় হাসপাতাল।
এদিকে ‘মানহানিকর’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে ‘মানিস্যুট’ মামলা করেছে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।