যানজটের শহর ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.12.28
ঢাকা
যানজটের শহর ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু ছোটবোন রেহানাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার দিয়াবাড়িতে উত্তরা (উত্তর) মেট্রোরেল স্টেশনে সবুজ পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল যাত্রার উদ্বোধন করেন। ২৮ ডিসেম্বর ২০২২।
[সৌজন্যে: তথ্য অধিদফতর]

বিশ্বে অন্যতম যানজটের শহর হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেল সেবা উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে মেট্রোরেলে চড়ে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে বুধবার উত্তরা এলাকার উত্তর স্টেশন (দিয়াবাড়ি স্টেশন নামে পরিচিত) থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা বৃহস্পতিবার থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

তবে এখনই ১২ কিলোমিটার দূরত্বের দুই স্টেশনের মধ্যের স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামছে না। অর্থাৎ যেসব যাত্রী উত্তরা থেকে আগারগাঁও যাবেন, তাঁরাই এই সুবিধা পাবেন। কিছুদিনের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে মেট্রোরেল সেবা চালু হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেলের মাধ্যমে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সাত কিলোমিটার গতির শহর ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসবে।

নতুন চালু হওয়া মেট্রোরেল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা, যা প্রতি ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন করতে পারবে ৬০ হাজার, প্রতি দিন মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন পাঁচ লাখ যাত্রী।

তবে তাঁদের মতে, যানজট থেকে মুক্তি পেতে প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা ও আশেপাশের এলাকা মেট্রোরেল সেবার আওতায় আনতে হবে।

আড়াই ঘণ্টার দূরত্ব ৩৮ মিনিটে

বুধবার উদ্বোধনী ট্রেনে ভ্রমণ করা তৌহিদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ট্রেনটি মাত্র ১৭ মিনিট ৩ সেকেন্ডে উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পৌঁছেছে, এই পথের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।”

তিনি বলেন, “উত্তর থেকে বাসে অথবা ব্যক্তিগত গাড়িতে অথবা সিএনজিতে মতিঝিল যেতে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। মেট্রোরেল চালু হলে মাত্র ৩৮ মিনিটেই এই পথ অতিক্রম করা যাবে।”

মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাকি অংশের নির্মাণ কাজ “প্রায় শেষ” জানিয়ে সড়ক পরিবহন সচিব এ. বি. এম. আমিন উল্লাহ নূরী বুধবার বেনারকে বলেন, “দুই এক মাসের মধ্যে ওই অংশে ট্রেন চালু করা সম্ভব হবে।”

তবে তিনি এ-সংক্রান্ত কোনো দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি।

তিনি বলেন, “২০৩০ সালের মধ্যে সমগ্র ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় মেট্রোরেল সেবা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। পুরো মেট্রোরেল প্রকল্প চালু হলে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় যানজট থাকবে না এবং এর আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।”

ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা মূলত এক স্তরের সড়কের ওপরেই নির্ভরশীল। ঢাকার আশেপাশে সার্কুলার নদীপথ থাকলেও তা কার্যকর করা যায়নি। সেকারণে যানজট ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী। শহরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বলেন, বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে যানজটের কারণে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় শতকরা তিন ভাগ নষ্ট হয়।

তিনি বলেন, “মেট্রোরেল উদ্বোধন করার মাধ্যমে ঢাকার একাংশের যানজট কিছুটা কমবে। জাইকা বলছে, কেবলমাত্র এই অংশে মেট্রোরেল বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা অপচয় রোধ করবে।”

“পুরো ঢাকা শহর মেট্রোরেলের আওতায় আনা গেলে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার অপচয় রোধ করা সম্ভব হতো,” বলেন আহসান এইচ. মনসুর।

জঙ্গি হামলায় নিহত জাপানীদের স্মরণ

কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক, প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে।

জাপানের আর্থিক সহায়তায় এই প্রকল্পের বর্তমান মূল্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বৈদেশিক মুদ্রায় তিন দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। পুরো প্রকল্পের শতকরা ৬০ ভাগ অর্থ আসছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা থেকে।

তবে শুরুতেই বিপত্তি দেখা দেয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। ওই বছরই ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফে হামলায় জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারান মেট্রোরেল প্রকল্পের সাত জাপানি পরামর্শক।

তাঁরা হলেন, হাসিমোতো হিদেকি, কুরোসাকি নোবুহিরো, ওগাসাওয়ারা কোয়ো, ওকামুরা মাকোতো, সাকাই ইউকো, শিমোদাইরা রুই এবং তানাকা হিরোশি। তাঁরা রাতের খাবার খেতে গিয়ে জঙ্গি হামলার মধ্যে পড়ে নিহত হন।

ওই হামলায় সাত জাপানি ছাড়াও নয় ইটালীয় নাগরিক, চার বাংলাদেশি, একজন ভারতীয় এবং আমেরিকান নিহত হন।

হামলার পর প্রকল্পের বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মধ্যে আলোচনার পর জাপানী নাগরিকরা এই প্রকল্পের কাজ আবার শুরু করেন।

হলি আর্টিজান হামলায় নিহত সাত জাপানি পরামর্শকের সম্মানে মেট্রোরেলের উত্তর স্টেশন প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়েছে।

“আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল নির্মাণে সাত জাপানি পরামর্শকের অবদান ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেছেন,” বেনারকে বলেন সড়ক সচিব আমিন উল্লাহ নূরী।

“গুলশান অংশে মেট্রোরেল শেষ হলে কয়েকটি স্টেশন নিহত জাপানি নাগরিকদের নামে নামকরণ করা হবে,” বলেন সচিব।

সবুজ পতাকা নেড়ে প্রধানমন্ত্রীর সংকেত

সবুজ পতাকা নেড়ে উত্তর উত্তরা স্টেশন থেকে মেট্রোরেল যাত্রার সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানা ও আরো প্রায় ২০০ যাত্রী নিয়ে বুধবার দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম যাত্রায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্পিকার, মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা, কূটনীতিক, স্কুল শিক্ষার্থী, জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ রেলে ভ্রমণ করেন।

নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে মরিয়ম আফিজা ছিলেন মেট্রোরেলের প্রথম চালক।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীদের পৌঁছে দেয়া ও সেখান থেকে যাত্রীদের নিয়ে আসতে ৩০টি ডবল ডেকার বাস পরিচালনা করবে।

ওগুলোর মধ্যে, ২০টি বাস আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল রুটে চলবে। আর ১০টি বাস উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে দিয়াবাড়িতে উত্তরার উত্তর স্টেশন পর্যন্ত চলবে।

দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের মাধ্যমে “বাঙালির গৌরব ও বাংলাদেশের উন্নয়ন মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হয়েছে,” বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।