মালয়েশিয়ায় জোর করে কাজে বাধ্য করার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশিদের মামলা

জন বেকটেল
2022.08.10
ওয়াশিংটন ডিসি
মালয়েশিয়ায় জোর করে কাজে বাধ্য করার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশিদের মামলা কুয়ালালামপুরের কাছে পেতালিং জায়ায় একটি বেডমিন্টন কোর্টে পরীক্ষার জন্য করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করার পর হাতের গ্লাভস খুলছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ১৮ জানুয়ারি ২০২১।
[এএফপি]

মালয়েশিয়ার রাবার কারখানায় শ্রমদাস হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করেছেন ১৩ জন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক।

মালয়েশিয়ায় কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিকের পক্ষে ১৩ বাংলাদেশির দায়ের করা মামলাটি পরিচালনা করছে ইন্টারন্যাশনাল রাইটস অ্যাডভোকেটস নামে আইনজীবীদের একটি মানবাধিকার সংগঠন।

বুধবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলেছে, মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কিম্বার্লি-ক্লার্ক ও আনসেল কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে, যেহেতু তারা শ্রমদাস নিয়োগকারী মালয়েশিয়ার রাবার কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য আমদানি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছে।

মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো অমানবিকভাবে শ্রমিকদের দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে রবারের দস্তানা (গ্লাভস) তৈরি করছে জেনেও যুক্তরাষ্ট্রের ঐ দুই কোম্পানি বেশি মুনাফার জন্য তাদের কাছ থেকে পণ্য আমদানি করছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের শিকার হওয়া হাজার হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়ার ব্রাইটওয়ে গ্রুপের মালিকানাধীন দস্তানা উৎপাদনকারী কারখানায় শ্রমদাস হিসেবে নিয়োজিত আছে এবং ওই ১৩ জন বাংলাদেশি তাঁদের পক্ষ হয়েই ওয়াশিংটনে ফেডারেল আদালতে মামলায় লড়বেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

মামলায় মালয়েশিয়ার ব্রাইটওয়ে গ্রুপকে মামলায় সরাসরি আসামি করা না হলেও ৭৮ পৃষ্ঠার মামলার নথিতে কোম্পানিটির নাম এসেছে ৩০০ বারের বেশি।

“মুনাফার জন্য এ ধরনের জোরপূর্বক শ্রমের ব্যবহার সত্ত্বেও আনসেল এবং কেসিসি তাদের জনখ্যাতি বজায় রাখার জন্য দাবি করে আসছে যে তারা আধুনিক দাস ব্যবস্থা মোকাবেলা ও অবসানে বদ্ধ পরিকর,” বলা হয়েছে অভিযোগে।

“এতে আমদানিকারক কোম্পানির আইনগত বা নৈতিক দায়িত্ব সম্পন্ন হয় না। কোম্পানি আদতে তাদের সরবরাহকারীদের জোরপূর্বক শ্রমের প্রতিকারের জন্য কিছুই করেনি বরং তাদের বিভিন্ন বিবৃতিতে কৌশলগতভাবে গ্রাহকদের বোকা বানিয়ে আসছে। বিবৃতিগুলি বরং প্রমাণ করে তারা সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের জোরপূর্বক শ্রম ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত, যা এ ব্যাপারে তাদের দায়দায়িত্বের স্বীকৃতিও বটে,” বলেছে বাদী সংগঠন।

বাড়তি সময় খাটতে বাধ্য করা হয়

ওয়াশিংটন ভিত্তিক ’ইন্টারন্যাশনাল রাইটস অ্যাডভোকেটস’ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কর্তৃক মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছে। তারা অভিযোগ করেছে, অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার প্রস্ততকারকের কারখানায় চাকরির জন্য নিয়োগকারীদেরকে ৪০০০ মার্কিন ডলারের (প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা) বেশি অর্থ প্রদান করেছে।

“সেখানে পৌঁছানোর পর অনেকেরই পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। একটি কক্ষে ৭০ জন মানুষকে থাকতে হয়। একমাত্র ঈদের দিন ছাড়া তাদের বিনা ছুটিতে দীর্ঘসময় টানা খাটুনিতে বাধ্য করা হয়,” জানায় সংগঠনটি।

এছাড়া, বাড়তি সময় কাজ করতে রাজি না হলে শ্রমিকদের “মজুরি কেটে নেওয়া, খাবার ও পানি সরবার এবং টয়লেটে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়,” বলেও অভিযোগ করা হয়।বলেছে সংগঠনটি।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্দরে ব্রাইটওয়ে গ্রুপের পণ্য খালাসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই আদেশ এখনো বহাল আছে। ব্রাইটওয়ে গ্রুপ ছাড়াও মালয়েশিয়ার আরও পাঁচটি দস্তানা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে।

“নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অ্যানসেল এবং কেসিসি ব্রাইটওয়ের কাছ থেকে দস্তানা আমদানি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তা বাজারজাত করে বিশাল মুনাফা করেছে,” বলা হয় অভিযোগে।

কিম্বার্লি-ক্লার্কের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে। তবে অ্যানসেল একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি, যুক্তরাষ্ট্রে যার অফিস রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল রাইটস অ্যাডভোকেটস-এর নির্বাহী পরিচালক টেরেন্স কলিংসওয়ার্থ, বলেছেন মার্কিন আদালতে মালয়েশিয়ান গ্লাভস প্রস্তুতকারকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা একেবারে আনকোরা। মামলা করার আগে মধ্যস্থতা এবং মীমাংসার জন্য চেষ্টা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন এই আইনজীবী।

“আমার জানামতে এটিই প্রথম মামলা। সিবিপি’র তদন্তের কারণে এই মামলাটি বেশ সহজ হবে,” বেনারকে বলেছেন কলিংসওয়ার্থ।

“আমি উভয় কোম্পানিকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সিবিপি’র প্রতিবেদন এবং ব্রাইটওয়ের সঙ্গে কেসিসি ও অ্যানসেলের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্পষ্ট থাকায় তারা মামলা লড়ার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে আইনজীবী সংস্থাগুলোকে নিয়োগের পরিবর্তে একটি সমাধান করার চেষ্টা করবে। কিন্তু না, তারা উভয়েই তা না করে মামলা মোকাবেলা করবে বলে জানিয়েছে।"

কিম্বার্লি-ক্লার্কের একজন মুখপাত্র বলেছেন, কোম্পানি “সব ধরনের বাধ্যতামূলক শ্রমের বিরুদ্ধে। আমরা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে আমাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে সমস্ত শ্রমিকের প্রতি মানবতার সাথে এবং আমাদের কর্মক্ষেত্রে মানবাধিকারের মান অনুযায়ী আচরণ করা হয়।"

“আমরা আমাদের চর্চা অনুযায়ী মামলার সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নিয়ে মন্তব্য করি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, কিম্বার্লি-ক্লার্কের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার আদৌ কোনো মেরিট নেই,” বেনারকে ইমেইলে জানান মুখপাত্র টেরি ব্যালক।

তবে অ্যানসেল এবং ব্রাইটওয়ের কর্মকর্তারা বেনারনিউজের মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিক সাড়া দেননি।

আইনজীবীর বক্তব্য

মামলা সংক্রান্ত বুধবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শ্রম অধিকার বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী কর্মীদের আইনজীবী অ্যান্ডি হল বলেছেন ব্রাইটওয়ে কর্মচারীরা “তাদের জীবনযাত্রা এবং কর্মপরিবেশের দুরবস্থার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আনতে আমার সহযোগিতা চেয়েছিলেন।”

তিনি বলেন, “অ্যানসেল এবং কেসিসির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো সমাধানের জন্য আমার প্রচেষ্টা মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে।"

“আমি আশা করি এই মামলার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীরা তাঁদের বেদনাদায়ক অবস্থার জন্য এই দুটি বহুজাতিক কোম্পানিকে দায়বদ্ধ করতে পারবে,” বলেন তিনি।

“কেসিসির সঙ্গে আমার চলমান আলোচনায় কিছু মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় বজায় থাকলেও আমি স্বীকার করি যে ব্রাইটওয়ে গ্রুপে বাধ্যতামূলক শ্রম পরিস্থিতি নিরসনের জন্য, কোম্পানির কর্মপদ্ধতির সংস্কারে এবং শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য কেসিসি প্রকৃতপক্ষে ইতিবাচক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে,” ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন হল।

“তবে কেসিসি’র এই প্রচেষ্টার সাথে অস্ট্রেলিয়ার অ্যানসেল কোম্পানির ভূমিকা একদম বিপরীত। অ্যানসেল আমাদের যোগাযোগে কোনো সাড়া দেয়নি এবং মালয়েশিয়ার ব্রাইটওয়ে গ্রুপের আধুনিক দাস ব্যবস্থার ভিকটিমদের প্রতিকার প্রদানের জন্য কিছুই করেনি,” বলেছিলেন তিনি।

জোরপূর্বক শ্রম, পাচার, অন্যায্য সমৃদ্ধি, তত্ত্বাবধানে অবহেলা এবং ইচ্ছাকৃত মানসিক যন্ত্রণার মতো পাঁচ দফা অন্যায়ের সাথে যুক্ত কোম্পানিগুলির কাছ থেকে পরিত্রাণের লক্ষে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় ১৩ জন বাংলাদেশিকে সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ প্রদানের আবেদন করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।