পাসপোর্ট ছাপানোর জটিলতা: নবায়ন না হওয়ায় বিদেশে বিপাকে বাংলাদেশিরা

জেসমিন পাপড়ি
2021.08.17
ঢাকা
পাসপোর্ট ছাপানোর জটিলতা: নবায়ন না হওয়ায় বিদেশে বিপাকে বাংলাদেশিরা ঢাকার কাওরান বাজারে একটি এয়ারলাইন্সের কার্যালয়ের সামনে টিকিটের জন্য সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের ভিড়। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

আড়াই মাস ধরে বেকার অবস্থায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ গোলাম মোর্শেদ। কারণ, তাঁর পাসপোর্টে মেয়াদ না থাকায় ভিসার মেয়াদও বাড়াতে পারছেন না তিনি। এই অবস্থায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে বাধ্যতামূলক দেশে ফিরতে হবে। 

মালয়েশিয়া থেকে গোলাম মোর্শেদ টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “একটি রেস্টুরেন্টে আমার চাকরি আছে। তারপরেও আমি অবৈধ (আনডকুমেন্টেড) হয়ে আছি। কারণ, আমার পাসপোর্ট-ভিসা নেই। অথচ প্রায় ১০ মাস আগে পাসপোর্ট রিনিউ (নবায়ন) করতে দিয়েছি। কিন্তু আজও পাইনি।”

“এখন মালয়েশিয়ার পুলিশ বা ইমিগ্রেশনের হাতে ধরা পড়লে তারা জেল জরিমানা দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেবে। তাছাড়া যে প্রতিষ্ঠান আমাকে কাজ দেবে তাকেও জরিমানা করবে। তাই এখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে আমার নতুন পাসপোর্ট হাতে পাওয়া,” বলে তিনি। 

গত কয়েকমাস নতুন পাসপোর্ট না পেয়ে গোলাম মোর্শেদের মতোই ভোগান্তিতে পড়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা। মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ সব দেশেই প্রবাসীরা এ সমস্যায় রয়েছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ সূত্র জানায়, জুনের শুরুতে এমআরপি সার্ভারের তিন কোটি পাসপোর্ট ছাপার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, গত চার সপ্তাহে কোনো পাসপোর্ট ছাপানো যায়নি। 

ছাপা বন্ধ হয়নি, তবে গতি কিছুটা শ্লথ: মহাপরিচালক

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের (ডিআইপি) মহাপরিচালক (ডিআইজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরীর মতে “পাসপোর্ট নিয়ে কোনো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। পাসপোর্ট প্রিন্ট কখনো বন্ধ হয়নি, তবে গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে।” 

“মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ব্যবস্থাকে সময়ে সময়ে আপগ্রেড করার প্রয়োজন হয়। সার্ভারের ৮-১০ রকমের জিনিস আছে। এর কোনোটার আপডেট চলছে, কোনোটা হয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি।

“আমাদের পাসপোর্টর সার্ভার আপগ্রেড করে মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান আইরিশ। এটি আপডেট করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে,” জানান মেজর জেনারেল আইয়ুব।

“এমআরপি অলরেডি ব্যাকডেটেড। আমাদের ই-পাসপোর্ট চালু করার কথা। কোভিড-১৯ এর কারণে ই পাসপোর্ট চালু না হওয়াতে এমআরপি চালু রাখলাম। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে, মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এর আগেও এ ধরনের সমস্যা হয়েছে। আমরা কাজ করছি সমাধান হয়ে যাবে,” বলেন ডিআইপি মহাপরিচালক। 

এ বিষয়ে মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “পাসপোর্ট মেশিনের প্রিন্টিংয়ের ঝামেলার কারণে বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকেরা পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারছেন না। এখন বিষয়টি সুরাহার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে।” 

মঙ্গলবার দুপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই ইস্যু নিয়ে আমরা অনেক দিন আলাপ করেছি। কারণ, অনেক বাঙালির পাসপোর্ট নবায়ন হচ্ছে না। তাঁরা পাসপোর্ট পাচ্ছেন না।” 

“এর মূল কারণ হচ্ছে পাসপোর্টের প্রিন্টিং আটকে গেছে। প্রবাসীদের মতো দেশেও অনেকে পাসপোর্টের জন্য বসে আছে। প্রিন্টিং মেশিনের গণ্ডগোল। পাসপোর্ট ইস্যু করে পাসপোর্ট অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছে। এখন এটা নিয়ে তারা আগে থেকে চিন্তা করেনি কেন, আমি জানি না,” বলেন তিনি। 

পাসপোর্টের কারণে ভ্রমণ করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। গত চার বছর ধরে দেশে ফেরেন না বাহরাইন প্রবাসী মোতালেব হোসেন। তিনি টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “এবার কুরবানির ঈদ (ঈদুল আজহা) দেশে ফিরে পরিবারের সঙ্গে কাটাব বলে আশায় ছিলাম। কিন্তু পাসপোর্টের মেয়াদ না থাকায় দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি।”

পাসপোর্ট হাতে পেয়ে ভিসা নবায়ন করার পরেই তিনি দেশে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। 

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাহিদামত পাসপোর্ট সরবরাহ করতে না পেরে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ ও লেবাননে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনগুলো থেকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এমআরপি সার্ভারে কারিগরি ত্রুটির কারণে পাসপোর্টের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। 

এ সমস্যা নিরসনে বেশ কয়েকটি দূতাবাস থেকে ডিআইপিকে চিঠিও পাঠানো হয়। গত ৩০ জুলাই এক নোটিশে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, বাংলাদেশে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকার কারণে ৮ জুনের পর যেসব পাসপোর্টের রি-ইস্যুর আবেদন করা হয়েছে, সেই পাসপোর্ট এখনও আসেনি। তাই, পরবর্তী নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করার অনুরোধ করা হয়। 

যথাসময়ে পাসপোর্ট দিতে না পেরে গত ৭ আগস্ট এক নোটিশে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, ঢাকায় পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সার্ভারের ধারণক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রচুর পাসপোর্ট জমা আছে। আওতা বহির্ভূত এই জটিলতার জন্য দুঃখ প্রকাশও করে হাইকমিশন। 

তবে ডিআইপি মহাপরিচালক পাসপোর্ট জটিলতার জন্য দূতাবাসগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “পাসপোর্টের জমার অনেকগুলো ধাপ আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাসপোর্ট আবেদন জমা করে দূতাবাসের নিজেদের কাছে রাখে। সে হিসাব আমাদের কাছে থাকে না। তারা অনলাইনে ইনপুট দিলে আমার আছে আসে।”

“আমার কাছ থেকে অ্যাপ্রুভাল নিয়ে দূতাবাসের কাছে যায়। যেগুলো পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের প্রয়োজন হয় সেগুলো সেখানে যায়। এখন কোন স্টেপে কত পাসপোর্ট জমে আছে সেটা আমি বলতে পারি না,” বলেন মেজর জেনারেল আইয়ুব। 

গত চার দিনে প্রিন্টিং সেকশনে দূতাবাসগুলোর অ্যাপ্রুভালের জন্য ৩২ হাজার পাসপোর্ট বসে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দূতাবাসের অ্যাপ্রুভাল পেলেই সেগুলো প্রিন্ট হবে।”

যে পরিমাণ পাসপোর্ট মালয়েশিয়াতে তৈরি হয়ে বসে আছে সেগুলোই দূতাবাস বিতরণ করতে পারছে না বলেও অভিযোগ করেন ডিআইপি মহাপরিচালক।

এ বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীর বেনারকে বলেন, “আমাদের এখান থেকে প্রায় ২০ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্টের অপেক্ষায় ডিআইপির সিস্টেমে জমা হয়ে আছে। আর আমাদের হাতে প্রস্তুত পাসপোর্ট রয়েছে ৫-৬ হাজার।” 

“করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মাত্র ৩৫-৩৬ টি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে দিনে প্রায় এক হাজার পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়। এগুলো কয়েক দিনের মধ্যেই বিতরণ করা হয়ে যাবে,” বলেন ডেপুটি হাইকমিশনার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।