বান্দরবানে গোলাগুলি: ৫ জঙ্গি গ্রেপ্তার, ৮ র‌্যাব সদস্য আহত

কামরান রেজা চৌধুরী ও আবদুর রহমান
2023.02.07
ঢাকা ও কক্সবাজার
বান্দরবানে গোলাগুলি: ৫ জঙ্গি গ্রেপ্তার, ৮ র‌্যাব সদস্য আহত বান্দরবানের জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সঙ্গে র‍্যাবের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন র‍্যাব মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন (মাঝখানে)। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাথে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সদস্যদের গোলাগুলির ঘটনায় আট র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে জেলার রেমাক্রি নতুন ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শুরু হওয়া এই গোলাগুলির ঘটনায় পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে।

রেমাক্রি ব্রিজ এলাকায় কেএনএফ এবং নব্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে সশস্ত্র ওই দুই সংগঠনের সদস্যরা গুলি ছোঁড়ে। র‌্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। থেমে থেমে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলির ঘটনা চলতে থাকে।

বান্দরবান জেলায় ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে কেএনএফ‘র এক সদস্য নিহত হওয়ার পর এটি দ্বিতীয় বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা।

২৩ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা শিবিরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর সেখান থেকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দুই সদস্যকে আটক করা হয়।

র‌্যাব বলছে, অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন সশস্ত্র বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া বান্দরবান ভিত্তিক সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সাথে একত্রিত হয়ে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করছে।

বিপরীত মেরুর দুই সংগঠনের সহযোগিতা অসম্ভব মনে হলেও সেটিই সত্য বলে মনে করছেন অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকেলে বান্দরবানের থানচি সীমান্ত পরিদর্শনে আসেন র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন।

সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, “সকালে থানচির রেমাক্রি এলাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে জঙ্গি ও কুকি চিনের সদস্যরা। এ সময় র‌্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুঁড়লে দুপক্ষের গোলাগুলি শুরু হয়।”

গোলাগুলির ঘটনায় পাঁচ জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

খুরশীদ হোসেন বলেন, র‌্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত এই জঙ্গি সংগঠনের ৩৮ সদস্য এবং ১৪ কুকি চিন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।

র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, সম্প্রতি মাসগুলোতে উগ্রবাদে ঝুঁকে স্বেচ্ছায় ‘হিজরতের নামে’ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয় ১৯ জেলার ৫৫ তরুণ। তাদের অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার আস্তানায় আশ্রয় নেয়।

এসব তরুণদের ভারি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয় পাহাড়ি বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এই দুই সংগঠনকে নির্মূল করতে ১৭ অক্টোবর থেকে যৌথ অভিযানে নামে র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। এর কারণে এসব এলাকায় পর্যটকদের চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়।

দুই মেরুর দুই সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতা

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “গতবছর র‌্যাবের অভিযানের পর প্রমাণিত হয়েছে যে, বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উপস্থিতি রয়েছে। আর স্থানীয় কোনো সংগঠনের সাহায্য ছাড়া সমতলের জঙ্গি সংগঠনের পক্ষে সেখানে ঘাঁটি স্থাপন করা অসম্ভব।”

তিনি বলেন, “এর কারণ হলো, সমতল এলাকার মানুষের চেহারা এবং পাহাড়ি এলাকার মানুষের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা। সমতলের মানুষ পাহাড়ি এলাকা এবং রাস্তাঘাট চেনে না।”

“সুতরাং, এটি বলা যায়, এই দুই সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে,” মনে করেন মেজর জেনারেল রশীদ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মধ্যে সহযোগিতা অসম্ভব মনে হবে। তবে আমি মনে করি দুই মেরুর দুই সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতা সম্ভব।”

কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “কুকি চিন ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের সদস্যরা মূলত বম গোষ্ঠীর সদস্য। এরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। হিন্দাল শারক্বীয়া ইসলাম ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। যেহেতু ইসলাম ও খ্রিস্টান দুই ধর্মই আহলে কিতাবি ধর্ম সেহেতু তারা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করতেই পারে।”

তাঁর মতে, “বান্দরবান জেলা পাহাড়ি, দুর্গম। সেখানে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা সমতলভূমি থেকে সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে গেলে তাদের অবশ্যই স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সহায়তা নিতে হবে।”

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের আর্থিক সংকট রয়েছে। অন্যদিকে তাদের হাতে অস্ত্র রয়েছে। অস্ত্র চালানোর পারদর্শিতা রয়েছে। অন্যদিকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অর্থ রয়েছে। সে কারণে তারা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলে র‌্যাব বলছে।”

এই বিশ্লেষকের মতে, “অতীতে র‌্যাব অস্ত্র উদ্ধার ও ক্রসফায়ারের কথা বলেছে সেগুলো মানুষ বিশ্বাস করেনি। এখন র‌্যাব হয়তো সঠিক কথা বলছে। কিন্তু মানুষ তাদের সত্য কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।