ব্লগার অনন্ত হত্যা: ভারতে গ্রেপ্তার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফয়সালকে দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী ও পরিতোষ পাল
2022.07.06
ঢাকা ও কলকাতা
ব্লগার অনন্ত হত্যা: ভারতে গ্রেপ্তার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফয়সালকে দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু ঢাকার শাহবাগে মোমবাতি জ্বালিয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে তাঁর সুহৃদদের স্মরণ। ১২ মে ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

সাত বছর আগে সিলেটে নিজের বাসার সামনে জঙ্গিদের হাতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফয়সাল আহমেদকে (২৭) ভারত থেকে এনে বিচারের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল-ইসলামের সদস্য ফয়সালকে সম্প্রতি ভারতের ব্যাঙ্গালুরু শহরে আটকের পর কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

ফয়সাল গ্রেপ্তারের ফলে অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডের দুই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আটক হলো।

“ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে, ব্যাঙ্গালুরু  শহরে আনসার আল-ইসলামের জঙ্গি ও অনন্ত বিজয় দাস হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফয়সাল ধরা পড়েছে,” বুধবার বেনারকে বলেন এন্টি টেররিজম ইউনিটের মুখপাত্র পুলিশ সুপার আসলাম খান।

ফসয়াল এখন “পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক বিষয়ে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আশা করি তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।”

কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) গোয়েন্দারা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু থেকে ফয়সালকে গ্রেপ্তার করেন বলে পুলিশের বরাত দিয়ে জানায় ভারতীয় গণমাধ্যম।

এ বিষয়ে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ প্রধান হরিকৃষ্ণ পাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসটিএফের এক সূত্র বেনারকে জানায়, ফয়সালের মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করে তাকে ১ জুলাই বেঙ্গালুরুর বোম্মানাহাল্লি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৩ জুলাই তাঁকে ট্রানজিট রিমান্ডে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।

কেন ব্লগাররা টার্গেট?

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের সাধারণ জনগণ।

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নেতৃত্বে ঢাকার শাহবাগে একদিনের মধ্যে হাজার হাজার সাধারণ জনগণ সমবেত হয়ে সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয়।

এই আন্দোলনের মধ্যেই জঙ্গিদের হাতে নিহত হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, যিনি গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। জঙ্গিরা রাজীবকে নাস্তিক হিসাবে আখ্যা দিয়ে হত্যার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূলত ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং দেশের রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগারদের হত্যার মিশনে নামে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলাম।

সারাদেশে টার্গেট করে হত্যা করা হয় প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও সংগঠকদের।

এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার মধ্য দিয়ে। একই বছর ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনন্ত বিজয় দাসকে। তিনি মৌলবাদ বিরোধী গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পর ২০২২ সালের ৩০ মার্চ সিলেটের সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইবুনাল অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় মোট চার জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমেদ, মামুনুর রশীদ এবং আবুল খায়ের রশীদ আহমেদ।

দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আবুল খায়ের রশীদ আহমেদ ছাড়া সবাই পলাতক।

দেশে আনলে গন্তব্য কারাগার

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ভারতে আটক জঙ্গি ফয়সালকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হলে আদালতে সোপর্দ করার পর কারাগারে পাঠানো হবে বলে বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার খন্দকার মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, “এরপর তাকে তার মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি পড়ে শোনানো হবে এবং সে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবে কি না সেব্যাপারে জানতে চাওয়া হবে।”

“যদি সে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আপিল করতে চায় তাহলে তাকে সেই সুযোগ দেয়া হবে। আদালত শুনবে কেন সে নিম্ন আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি,” বলেন মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, “আদালত তার অনুপস্থিতির কারণ শুনে সন্তুষ্ট হলে আপিল আবেদন গ্রহণ করতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো গ্রহণ করা হয় না। এর কারণ আইনের অনুকম্পা পেতে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পলাতক ব্যক্তি আইনি অনুকম্পা পেতে পারে না।”

দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব

বাংলাদেশ ও ভারত ২০০৯ সালের পর থেকে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে  নিবিড়ভাবে সহযোগিতা চালু রেখেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং সেই বছর অক্টোবরে আইনটি কার্যকর হয়।

এই চুক্তি অনুযায়ী কোনো এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে ধরা পড়লে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হয়।

বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে আটক ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়াকে ২০১৫ সালের নভেম্বর ভারতের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। ভারতও সাজাপ্রাপ্ত এক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।