তিন দিনে মৌলভীবাজারে গ্রেপ্তার ২৭ সন্দেহভাজন জঙ্গি
2023.08.14
ঢাকা
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় একটি পাহাড় ঘেঁষা বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলেছে এমন সন্দেহে অভিযান চালিয়ে নারী-পুরুষসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের দুই দিনের মাথায় একই এলাকা থেকে আরও ১৭ জনকে ধরে পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী।
সোমবার স্থানীয়দের মাধ্যমে আটক হওয়া ১৭ জনের মধ্যে একজন চিকিৎসক ও দুই জন প্রকৌশলী রয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
এদিন সকালে সাধারণ মানুষ এই সন্দেহভাজনদের আটকের পর স্থানীয় কর্মধা ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে আটকে রাখে এবং পরবর্তীতে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ইউপি চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে শনিবার সকালে চার ঘণ্টার অভিযান ‘অপারেশন হিলসাইড’ পরিচালনা করে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন সংগঠনের প্রধানসহ ১০ জনকে আটক করা হয়।
আসাদুজ্জামান বলেন, “আমরা ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর বলেছিলাম অপারেশনের সময় ডা. সোহেল তানজিম রানাসহ বেশ কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এখন হয়তো অপারেশনাল প্রয়োজনেই তারা সমতলে এসেছে এবং স্থানীয়দের বিচক্ষণতায় আটক হয়েছে।”
ওই পাহাড়ি এলাকায় আরও জঙ্গি আস্তানা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মঙ্গলবার সকালে অভিযান পরিচালনা করবে সিটিটিসি।”
তবে সোমবার আটকদের বিস্তারিত পরিচয় জানায়নি পুলিশ।
যেভাবে আটক ১৭ সন্দেহভাজন
মুহিবুল ইসলাম আজাদ বেনারকে বলেন, “সোমবার সকালে চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে রোগী ও যাত্রী বেশে ১৭ জন লোক ওঠেন। এক পর্যায়ে যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে এবং পরনের কাপড়ে কাদা দেখে অটোরিকশা চালকদের সন্দেহ হয়।”
“মোবাইল ফোনে কথা বলে তারা একে-অন্যকে নিজেদের সন্দেহের বিষয়টি জানান এবং অটোরিকশা স্ট্যান্ডের কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ১৭ জনকে স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যান,” বলছিলেন আজাদ।
প্রথমে এই ১৭ জনকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর থানায় জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুছ ছালেক বলেন, “পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে আটকদের জিম্মায় নেয় এবং পরে ঢাকা থেকে সিটিটিসি ইউনিটের সদস্যরা এলে তাদের হাতে হস্তান্তর করে।”
তিনি আরও বলেন, “শনিবার ছয় জন নারীসহ ১০ জনকে জঙ্গি সন্দেহে আটকের পর থেকে এলাকায় বিষয়টি নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য ছিল। মানুষ সচেতন ছিল বলেই এদের আটক করা সহজ হয়েছে।”
সিটিটিসির দাবি, ইমাম মাহমুদ নামে এক ব্যক্তির আহ্বানে সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতির জন্য কথিত হিজরতের মাধ্যমে নিজ নিজ গৃহত্যাগ করে সপরিবারে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করছে সংগঠনটির সদস্যরা।
আসাদুজ্জামান বলেন, “ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামে এই সংঘবদ্ধ গ্রুপ প্রশিক্ষণ শেষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা করছিল।”
প্রসঙ্গত, এর আগে আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি হাই এক্সপ্লোসিভ তৈরিতে ব্যবহৃত তিন কেজি বিস্ফোরক, ৫০টি ডেটোনেটর, নগদ ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা, জঙ্গি প্রশিক্ষণ সামগ্রী ও বিপুল সংখ্যক জিহাদি বই উদ্ধার করে।
শনিবার গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে একজন ছিলেন ডা. তানজিমের স্ত্রী মাইশা ইসলাম হাফসা। সিরাজগঞ্জের একটি হাসপাতালে চাকুরিরত তানজিম গত ২৬ জুলাই থেকে সস্ত্রীক নিখোঁজ ছিলেন।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তানজিমের বাবা আব্দুল হান্নান।
ছেলের মুখ দেখতে চান না কৃষক বাবা
“আমি একজন কৃষক, কৃষি কাজ করে ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছি। সে যে জঙ্গি হয়ে যাবে এটা আমি কল্পনাও করতে পারি না,” এভাবেই ছেলে সম্পর্কে বেনারের কাছে নিজের অভিব্যক্তি জানান হান্নান।
তিনি আরও বলেন, “এই ছেলেকে নিয়ে আমার কোনো চাওয়া নেই। সে ছাড়া পাক বা মারা যাক, এটা নিয়ে আমার কিছুই যায়-আসে না। আমি এই ছেলের মরা মুখও দেখতে চাই না।”
তাঁর ছেলে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না জানিয়ে হান্নান বলেন, “আমার পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগের সমর্থক, ছেলেও তাই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো যে, ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ল তা আমাদের মাথায় আসছে না।”
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে এসএসসিতে এ গ্রেড ও ২০১৩ সালে এ প্লাস নিয়ে এইচএসসি পাস করেন সোহেল তানজিম রানা। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
হান্নান জানান, প্রায় তিন মাস আগে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছেন তানজিম।
গত ঈদুল আজহার কিছু দিন পর থেকেই তানজিম পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
ছেলের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা খুব কষ্ট দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই ঘটনা আমার পরিবারকে ভীষণ লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।”