হলি আর্টিজান হামলা: জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাবাস
2023.10.30
ঢাকা
গুলশানের হলি আর্টিজান হামলায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে সাত আসামিকে বিচারিক আদালতে দেয়া মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে আমৃত্যু কারাবাস দিয়েছে হাইকোর্ট।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড মামলার ডেথ রেফারেন্স এবং দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিলের রায়ে বিচারপতি সহিদুল করিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করেন। বেনারকে এ কথা জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে কোনও জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার ঘটনা এটাই প্রথম।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সন্ত্রাস দমন আইন অনুযায়ী বিচারিক আদালত ওই সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু আজকে হাইকোর্ট বলেছে, এই সাত জঙ্গি সরাসরি হামলায় অংশ নেয়নি। তারা এই হামলার চক্রান্তকারী, উৎসাহ প্রদানকারী এবং উস্কানিদাতা। সুতরাং, তাদেরকে সহযোগী হিসাবে আমৃত্যু কারাবাস দিয়েছেন আদালত।
আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিকসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে যে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে।”
এই অপরাধে আপিলকারী জঙ্গিরা আমৃত্যু কারাবাসসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন বলে জানান বশির আহমেদ।
সরকারপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কি না সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
এই রায় প্রসঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম আদালতে সাংবাদিকদের বলেন, “এই হামলার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত তাঁরা ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত নন।”
তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন আইন-২০০৯ অনুযায়ী সন্ত্রাসের দায়ে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যান্য মেয়াদের সাজার বিধান থাকলেও “আমৃত্যু কারাবাসের কোনো বিধান নেই।”
যাদের আমৃত্যু কারাবাস দেয়া হয়েছে তাঁরা হলেন; জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
হামলার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিচারিক আদালত এই হামলার দায়ে ওই সাত নব্য জেএমবি জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড়ো মিজানকে খালাস দেয় আদালত।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান-২ এলাকার অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে নৃশংসভাবে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করে পাঁচ জঙ্গি। এদের মধ্যে নয় জন ইতালীয়, সাত জন জাপানি, একজন ভারতীয় ও তিন জন বাংলাদেশি।
রাতভর জঙ্গিরা ওই রেঁস্তোরায় অবস্থান নেয়। পরদিন সকালে বাহিনীর কমান্ডোরা অপারেশন চালিয়ে ওই পাঁচ জঙ্গিকে হত্যা করে হলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তবে জিম্মি ঘটনার রাতেই আইএস সমর্থিত মিডিয়ায় হলি আর্টিজানের ঘটনায় কতজন নিহত হয়েছেন সে বিষয়ে খবর প্রকাশ করে।
যৌথ বাহিনীর অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযান চলাকালে ও পরে হাসপাতালে হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারীও মারা যান।
হলি আর্টিজান হামলার পরে সারা দেশে জঙ্গি দমন অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করে পুলিশ। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এ হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আট জঙ্গি নিহত হওয়ায় জীবিত থাকা আট জনকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়।
২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই হামলা মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় ১১৩ জন সাক্ষী হাজির করে।
পুলিশ জানায়, এই হামলায় জড়িত গোষ্ঠীর নাম নব্য জেএমবি। তারা ঘটনার পর নিজেদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বলে দাবি করেছিল। যদিও তাদের সাথে আইএসের কোনো সংযোগ ছিল না।
তবে নব্য জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (নব্য জেএমবি) নিজেদের সিরিয়া-ভিত্তিক নৃশংস কট্টরপন্থী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্য মনে করত।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় আসামিরা মাথায় আইএসের কালো টুপি পরে ইসলামিক স্টেটের শ্লোগান দিতে দিতে প্রিজন ভ্যানে ওঠে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া
জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ড বাদ দেওয়ায় রায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হারুন আল রশীদ সোমবার বেনারকে বলেন, “একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সত্যিই কষ্টের। কিন্তু এরা জঙ্গি, এরা হত্যাকারী। এদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সমস্যা হলো, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হলে কোনো সরকার যে এদের কারাগার থেকে বের করে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।”
হারুন আল রশীদ বলেন, “সে কারণেই আমি মনে করি এই জঙ্গিদের ফাঁসি হওয়া উচিত।”
তবে সাবেক জাতীয় মানবাধিকার কমিশনার অধ্যাপক মিজানুর রহমান আদালতের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।
তিনি সোমবার বেনারকে বলেন, “আমার মতে, আদালত যে রায় দিয়েছে সেটি খারাপ কিছু না। এটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু নেই।”
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “সারা বিশ্বে এখন মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। যে দেশে মৃত্যুদণ্ড কম হয় সেই দেশকে অনেকটাই সভ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।”
তিনি বলেন, “অবশ্যই তারা (জঙ্গিরা) জঘন্য অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট। সে কারণে তাদের সারা জীবনের জন্য কারাগারে আটক রাখা খুব কম সাজা নয়। মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে তো সব শেষ। কিন্তু আমৃত্যু কারাবাস অনেক কঠিন শাস্তি।”
তাঁর মতে, “এই সকল জঙ্গিরা যেন কারাগারের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদ প্রচার না করতে পারে সেজন্য কারা কর্তৃপক্ষের উচিত, প্রাথমিকভাবে তাদের অন্যান্য সাধারণ কয়েদি থেকে আলাদা করে অন্য স্থানে রাখা।”
তিনি বলেন, কারাগারে তাদেরকে কাউন্সেলিং করে, বিভিন্ন মোটিভেশনের মাধ্যমে পরিবর্তন করে “যখন কারা কর্তৃপক্ষ মনে করবে তাদের পরিবর্তন হয়েছে, তখন তাদের সাধারণ কয়েদিদের সাথে মিশতে দেওয়া উচিত।”