ছিনিয়ে নেয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা
2022.11.21
ঢাকা
ঢাকার আদালত এলাকা থেকে রোববার ছিনিয়ে নেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে সোমবার রাত পর্যন্ত ধরতে পারেনি পুলিশ, যদিও ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জঙ্গি পালানোর ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে সোমবার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
পুলিশের একাধিক ইউনিট চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি তদন্ত করছে এবং তদন্তকারীদের সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত শীর্ষ জঙ্গি নেতা জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট জানিয়েছে, তারা আসামিদের ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
রোববার এই ঘটনায় জিয়াকে প্রধান আসামি করে পলাতক আসামি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবসহ মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তাদের মতে, আসামিরা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।
রোববার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে ‘পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে’ জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি পালিয়ে যায়।
ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত, নেতৃত্বে জিয়া: ডিবি
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় শীর্ষ জঙ্গি নেতা জিয়া নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।
সোমবার ডিএমপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “জঙ্গিদের আদালত এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে অংশ নিয়েছিল ১৮ জন।”
পরিকল্পনাকারীদের ধরতে সব রকম চেষ্টা চলছে। তারা সবাই নজরদারিতে আছে দাবি করে হারুন বলেন, শিগগির তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি জানান, জঙ্গি ছিনতাইয়ে অংশ নেয়া ১৮ জঙ্গির মধ্যে ছয়জন সরাসরি ও বাকি ১০ থেকে ১২ জন আদালত এলাকায় আগে রেকি করেছে।
এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, পালাতে না পেরে ধরা পড়া দুই দণ্ডপ্রাপ্ত উগ্রবাদী আরাফাত রহমান ও আবদুস সবুর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আগেই অবগত ছিল।
“সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং রাজনীতিবিদ, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যার অংশ হিসেবে এই আসামি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল,” বলা হয় এজাহারে।
পাঁচ পুলিশ বরখাস্ত
জঙ্গি পালানোর ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
সাময়িক বরখাস্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন; সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ (এসআই) নাহিদুর রহমান ভুঁইয়া, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বরত পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শরিফ হাসান ও আব্দুস সাত্তার।
দুই আসামি পালিয়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা থাকায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান ডিএমপি প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন হবেও বলে জানান তিনি।
এদিকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান সোমবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা অতর্কিত হামলা ও ছিনতাইয়ের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি এই চিহ্নিত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেননি।
এই ঘটনায় পুলিশ সদরদপ্তর ও ডিএমপি পৃথক দুটি কমিটি গঠন করেছে।
অপরদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আগের অপরাধের ধরন এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির পায়ের ছাপ বিশ্লেষণ করছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, “গোয়েন্দা শাখাসহ র্যাবের সব ইউনিট পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালাচ্ছে।”
প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশের ভূমিকা
পুলিশের হেফাজত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি এভাবে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
“এটা পুরোপুরি পুলিশের ব্যর্থতা এবং এর পেছনে বড়ো ধরনের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, “এই ঘটনায় পুলিশের তরফ থেকে কোনো ধরনের অজুহাত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যারা আবার জঙ্গি তাদের কীভাবে এমন ঢিলেঢালাভাবে আদালতে তোলা হয়, সেটা বোধগম্য নয়।”
একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কেন ডান্ডাবেড়ি ছাড়া আদালতে নিয়ে আসা হলো, যেখানে অনেক সাধারণ আসামিকেও আদালতে হাজির করার সময় বিপুল পুলিশের সমাগম ঘটানো হয়- প্রশ্ন তোলেন সাখাওয়াত।
“আমরা হয়তো এখন খবর পাব, এই জঙ্গিরা ক্রসফায়ারে মারা গেছে। এসব নাটকের আসলে কোনো মানে হয় না,” বলেন তিনি।
এদিকে আদালত থেকে জঙ্গি পালানোর ঘটনার প্রকৃত সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ে ঘটনা ‘আবার সেই জঙ্গি নাটক’ কিনা, এমন প্রশ্ন উঠেছে বলে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “কী খোঁড়া যুক্তি? স্প্রে করে জঙ্গি, কনভিক্টেড জঙ্গি, তাকে নাকি পুলিশ সদস্য নিয়ে আসতেছিল। এটা কেমন করে হতে পারে? অসম্ভব ব্যাপার।”
“সেই ক্ষেত্রে জনগণের কাছে প্রশ্ন জেগেছে আবার সেই জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে কিনা। যাতে করে তাদের আবার ক্ষমতায় টিকে থাকা স্থায়ী হতে পারে, কিছুটা সময় পায়। আমরা জনগণের প্রশ্নটাই তুলে ধরলাম। আমরা বিশ্বাস করি এসকল অশুভ চক্রান্ত থেকে সরকার সরে দাঁড়াবে,” বলেন ফখরুল।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বইমেলার কাছেই বাংলাদেশি-আমেরিকান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর হামলাকারীরা প্রকাশ্যে আক্রমণ করে। চাপাতির আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান অভিজিৎ।
অপর দিকে একই বছরের অক্টোবরে অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা।