প্রস্তাবিত বাজেটে বৈষম্যের অভিযোগ সংখ্যালঘুদের
2023.06.20
ঢাকা
বাংলাদেশের নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।
তাঁদের ভাষ্য, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয় যে, সংখ্যালঘুরা সীমাহীন অবজ্ঞা, অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার।
মঙ্গলবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ তোলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। গত কয়েক মাস ধরে বাজেট বরাদ্দে সমতার দাবিতে তারা রাজপথেও আন্দোলন করছে।
আগামী ২৫ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হওয়ার কথা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সংসদে প্রস্তাবিত ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে “ধর্মীয় বৈষম্যের কোনোরূপ পরিবর্তন না আসায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।”
বাজেটে সংখ্যালঘুদের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় অভিযোগ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বাজেট বরাদ্দ “সীমাহীন অবজ্ঞা, অবহেলা ও বৈষম্যের এক সুস্পষ্ট প্রমাণ।
তিনি বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় এবং উন্নয়ন খাতে মোট ২ হাজার ১৭৬ দশমিক ১৫ কোটি টাকার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যে বরাদ্দ মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও কল্যাণে গঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছরের বাজেট বরাদ্দ থেকে চলে জানিয়ে তিনি বলেন, “হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টগুলো চলে আমানতের সুদের টাকায়।”
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের উদাহরণ টেনে তিনি জানান, এ প্রতিষ্ঠানের জন্য মোট স্থায়ী আমানতের ১০০ কোটি টাকা থেকে প্রতি বছরে ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা সুদ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি পেয়ে থাকে। যার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি অফিস খরচ এবং বাকি টাকা দুস্থ ও মন্দিরে অনুদান এবং ক্ষুদ্র পরিসরে বিভিন্ন তীর্থ পরিক্রমার জন্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করে থাকে।
“হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টে বর্তমানে জনবল রয়েছে নয় জন, তার মধ্যে দুই জন মুসলিম সম্প্রদায়ের। মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে জেলাগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রায় ৪০ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের,” বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুরোহিত ও সেবায়েত দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পটি হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। এই প্রকল্পের জনবলের মধ্যেও ১০ শতাংশের বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী।”
“বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই বৈষম্যমূলক বরাদ্দ খুবই হতাশাজনক,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনেন্দ্র কুমার নাথ।
তিনি বলেন, “১৯১৭-১৮ অর্থবছরের পর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ বাড়ছেই না। আনুপাতিকভাবে বিবেচনা করলেও এটা ৯ শতাংশ হওয়া উচিত।”
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
সংবাদ সম্মেলনে রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, “বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যার ফলশ্রুতিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায় প্রায় সম্পূর্ণ রূপে ধর্মীয় চেতনাহীন ও নৈতিক শিক্ষাহীন হয়ে গড়ে উঠছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক মাসিক সর্বসাকুল্যে ১৭৯ টাকা এবং একজন কর্মচারী মাসিক ৭৮ টাকা বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন।”
তিনি জানান, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদের জাতীয় পে-স্কেলভুক্তকরণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষক সমিতির মহাসচিব ২০১৯ সালের মার্চ মাসে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি আবেদন করেছেন।
“আবেদনপত্রে পরিকল্পনামন্ত্রী ‘বিহিত ব্যবস্থার জন্য’ সুপারিশ করেছিলেন কিন্তু এ পর্যন্ত আবেদন সরকারের বিবেচনায় আসেনি,” বলেন রানা দাশগুপ্ত।
দাবি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়
সংবাদ সম্মেলনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ছয়টি দাবি তুলে ধরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
বিগুলোর মধ্যে রয়েছে—সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন ও কল্যাণে রাজস্ব থেকে বার্ষিক বরাদ্দ দিয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টগুলোকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা; সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঠিক শুমারির উদ্যোগ গ্রহণ; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন এবং সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের জাতীয় পে-স্কেলভুক্তকরণ।
সংগঠনটির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুদান ও অডিট অধিশাখার উপসচিব মঞ্জুরুল হক বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্র অবশ্যই কোনো বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না। কোনো সুনির্দিষ্ট আপত্তি থাকলে তা অবশ্যই বিবেচনা করা যেতে পারে।”
এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “আমরা দীর্ঘ দিন থেকেই বলে আসছি সংখ্যালঘুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ শুধু অপ্রতুলই নয় বৈষম্যমূলক।”
“এই ধরনের বাজেট ব্যবস্থাপনা যেটি ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য তৈরি করে তা বাংলাদেশের সাংবিধানিক চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক,” বলেন তিনি।