কুমিল্লার পূজা মণ্ডপে অপ্রীতিকর ঘটনার জের, চাঁদপুরে নিহত ৪
2021.10.14
ঢাকা
কুমিল্লার একটি পূজা মণ্ডপ থেকে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার জের ধরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বুধবার রাতে পুলিশের গুলিতে চাঁদপুর জেলায় অন্তত চারজন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এড়াতে ঢাকা ও সিলেট মহানগর এবং দেশের ৩০ জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় বাহিনীর পক্ষ থেকে জানান বিজিবির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান।
গত সোমবার শুরু হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বড়ো এই ধর্মীয় উৎসব শুক্রবার বিজয়া দশমীর মাধ্যমে শেষ হবে।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “কুমিল্লার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের খুঁজে বের করব। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যে ধর্মের হোক না কেন বিচার করা হবে।”
এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, গতবারের চেয়ে এবার এক হাজার ৯০৫টি মণ্ডপ বেড়েছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
কুমিল্লার ঘটনার পর পূজামণ্ডপে ভক্তদের ভিড় কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ঢাকার মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দিরের সভাপতি অসীম কুমার রায় শিশির বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে বলেন, “বিকেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য এবং বিজিবি মোতায়েনের খবরে সবাই আশ্বস্ত হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে পূণ্যার্থীদের সমাগম বেড়েছে।”
এদিকে “জেলা প্রশাসনের চাহিদার প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে,” বলে জানান বিজিবির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং অপরাধীরা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
চাঁদপুরে নিহত চার
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ পৌর শহরে বুধবার রাতের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ চারজন নিহত হন। হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, নিহতদের তিনজন স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং একজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কমেক) হাসপাতালে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমেক হাসপাতালের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নিহতরা হলেন; হাজীগঞ্জ পৌরসভার রান্ধুনীমূড়ার ফজলুল হকের ছেলে হৃদয় হোসেন (১৪), তাজুল ইসলামের ছেলে আলামিন (১৮), আব্বাস উদ্দিনের ছেলে শামীম (১৭) এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের শামছুল হকের ছেলে মো. বাবলু (৩৫)।
গুরুতর আহত আরো একজনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওসি।
এর আগে হাজীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেনারকে জানান, বিভিন্ন পূজামণ্ডপে স্থানীয় মুসল্লিদের হামলার জেরে পুলিশের সাথে তাঁদের সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বুধবার রাত ১১টা থেকে সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার বিকেলে হাজীগঞ্জের ওসি জানান, ইতিমধ্যে সাতজনকে আটক করেছেন তাঁরা।
এ ছাড়া সেখানকার ঘটনা তদন্তে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অঞ্জনা খান।
যেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত, সেই কুমিল্লায়ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান।
উদ্দেশ্য নিয়েই ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা: ডিআইজি
কুমিল্লার নানুয়া দিঘী সংলগ্ন দর্পণ সংঘের বিধ্বস্ত মণ্ডপটি পরিদর্শনের পর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাস্থলের যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেটি ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া ফয়েজ উদ্দীন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
“ভিডিওটি দেখলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এ ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা,” উল্লেখ করে ডিআইজি আরো জানান, কোরান অবমাননা ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায় কুমিল্লায় বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ৪৩ জনকে আটক করা হয়েছে।
“ওই ৪৩ জনের সবাই অপরাধী নয়,” জানিয়ে কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানার ওসি আনওয়ারুল আজিম বিকেলে বেনারকে বলেন, “আসামিদের চিহ্নিত করতে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এনেছি আমরা।”
কুমিল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে থানায় কোনো অভিযোগ আসেনি, পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
কুমিল্লা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার সেখানে নতুন করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লার কোতয়ালি মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটিসহ মোট চারটি মামলা দায়ের হয়েছে বলে বেনারকে জানান ওসি আনোয়ারুল আজিম।
অন্যদিকে হাজীগঞ্জ থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুই হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে বলে জানান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ।
কুমিল্লার ঘটনার জেরে দেশে দ্বিতীয় দিনের মতো সাম্প্রদায়িক নৈরাজ্য চলছে বলে দাবি করেছেন সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা।
“দুই দিনে দেশের ১৮টি জেলার মণ্ডপ-মন্দিরের ৪৮টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার ১১৩টি হিন্দু বাড়িও নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছে,” বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী মহাসচিব ও মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে।
কিছু এলাকায় হিন্দুদের বাসা-বাড়িতে হামলা হয়েছে উল্লেখ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড়ো সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বেনারকে বলেন, “সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে নোয়াখালীর চৌমুহনীর সোনাইমুড়িতে প্রতিমা ভাংচুরের খবর পেয়েছি।”
এই দুই নেতার দাবি, চলমান সাম্প্রদায়িক নৈরাজ্যের দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজীপুর, বান্দরবান, কক্সবাজার, গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও হবিগঞ্জে সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েছেন তাঁরা।
বিভিন্ন এলাকায় হামলাকারী গ্রেপ্তার
গাজীপুর মহানগরের কাশিমপুর বাজার এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে তিনটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০ জনকে পুলিশ আটক করেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার ডিসি এসএম তরিকুল ইসলাম।
আগের রাতে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় পূজাবিরোধী মিছিল থেকে পুলিশ ও প্রশাসনের গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত দুইজনকে আটক করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন ইউএনও সুমী আক্তার।
এছাড়া কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় পূজামণ্ডপ ও হিন্দু বাড়িতে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নয়জনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
এই গ্রেপ্তারের সমালোচনা করে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা কুমিল্লায় লক্ষ্য করছি, অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করে প্রশাসন উল্টো প্রতিবাদরত মুসলমানদের উপরই চড়াও হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রগতিশীল বিভিন্ন ব্যক্তি-সংগঠন চলমান সাম্প্রদায়িক অরাজকতার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।
কুমিল্লার হামলা পরিকল্পিত এবং এর জন্য সরকারকে দায়ী করেছে বিরোধী দল বিএনপি। রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “বিদ্যমান সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”