সাম্প্রদায়িক হামলায় নোয়াখালীতে নিহত এক, ঢাকায় পুলিশ-মুসল্লি সংঘর্ষ
2021.10.15
ঢাকা
কুমিল্লা থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জেরে শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরশহরে মুসল্লিদের হামলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) এক ভক্ত নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
কুমিল্লায় হিন্দুদের পূজামণ্ডপ থেকে বুধবার কোরআন শরীফ উদ্ধার পরবর্তী বিক্ষিপ্ত সংঘাতের তৃতীয় দিনে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই ব্যক্তির নাম যতন কুমার সাহা (৪২)।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাত সোয়া আটটায় বেগমগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক বেনারকে জানান, চৌমুহনীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে পুলিশের প্রায় দেড়শ সদস্য আহত হয়েছেন।
“আমাদের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান শিকদারসহ থানার যারা আজ মাঠে দায়িত্বরত ছিলাম, তারা সবাই কমবেশি আহত হয়েছি। এছাড়া পরিস্থিতি সামলাতে নোয়াখালী পুলিশ লাইন ও সোনাইমুড়ি থেকে যারা এসেছিলেন তাঁদের অনেকে আঘাত পেয়েছেন,” বলেন এসআই এনামুল।
তবে সেখানে কতসংখ্যক বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন তা জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড়ো সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নোয়াখালী জেলা সদস্য সচিব পাপ্পু সাহা রাত আটটায় মুঠোফোনে বেনারকে জানান, যতন কুমার সাহার মৃত্যু ছাড়াও
প্রভু নিমাই কৃষ্ণ দাশ নামে আরেকজন “হামলায় আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। আরো শত শত হিন্দু আহত হয়েছে।”
তবে “ওই হামলায় পাঁচ-সাতজন আহত হয়েছেন, এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আর পুলিশের চারজন আহত হয়েছেন,” বলে রাত সোয়া ১০টায় বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান।
চৌমুহনীতে হিন্দুদের ১২টি মন্দির, ৩০টি দোকান এবং প্রায় একশ ঘরবাড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়েছে দাবি করে পাপ্পু সাহা বলেন, “হামলাকারীরা মন্দিরগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। আমাদের তিনটি গাড়ি এবং ছয়টি মোটরসাইকেলও জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা।”
এই সংখ্যালঘু নেতার অভিযোগ, হামলার আশঙ্কা থাকলেও পুলিশ আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শহীদুল ইসলামের মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে, একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
তবে এসআই এনামুল অভিযোগটি অসত্য দাবি করে জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে পুলিশ, যার প্রমাণ এতসংখ্যক পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনা।
“জুমার নামাজের পর তিন-চার হাজার মানুষ কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে একযোগে একাধিক জায়গায় হামলা শুরু করে,” জানান পাপ্পু।
স্থানীয় সংখ্যালঘুদের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের একাংশের নির্বাহী মহাসচিব ও মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে বেনারকে বলেন, চৌমুহনী ছাড়াও নোয়াখালীর অন্যান্য এলাকার “আরো সাতটি মন্দিরে দুপুরের পর হামলা হয়েছে।”
“প্রশাসন তিনদিনেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে,” বলেন তিনি।
তবে পরিস্থিতি “বিকেল পাঁচটার পর থেকে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে,” জানিয়ে তবে নোয়াখালীর ডিসি বেনারকে বলেন, চৌমুহনী পৌরসভা এলাকায় শনিবার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
ঢাকায় সংঘর্ষ
শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ থেকে কুমিল্লার ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হওয়া মুসল্লিদের সাথে আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. সাজ্জাদুর রহমান এবং মতিঝিল বিভাগের ডিসি মো. আব্দুল আহাদ।
এই দুই কর্মকর্তার ধারণা, দুই থেকে আড়াই হাজার মুসল্লি এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।
বিশৃঙ্খলা এড়াতে আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ পুরো এলাকায় নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছিল। তার মধ্যেই ‘মালিবাগ মুসলিম যুব সমাজ’ লেখা ব্যানার নিয়ে মিছিল বের করা বিক্ষোভকারীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
নামাজ শেষে বের হওয়া মিছিলটি পুরানা পল্টন মোড় ও বিজয়নগর হয়ে নাইটেঙ্গেল মোড়ে পৌঁছায়। সেখানে তিন দিক থেকে ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশ তাদের আবার পল্টনের দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মিছিলকারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়।
রমনার ডিসি বেনারকে বলেন, “তাদেরকে ‘ইউটার্ন’ করিয়ে দেওয়ার আগেই তারা পুলিশের দিকে জুতা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এরপর তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কিছু রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসও ব্যবহার করেছি আমরা।”
মতিঝিলের ডিসি জানান, পরে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশের তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন, তবে কোনো বিক্ষোভকারী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামেও হামলা
এদিকে জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় একটি মসজিদের সামনের সমাবেশ থেকে “মিছিল নিয়ে এসে জেএমসেন হলের পূজামণ্ডপে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়,” বলে বেনারকে জানান হিন্দু মহাজোটের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র পলাশ।
তিনি বলেন, “তারা প্রতিমা লক্ষ্য করে ইট-পাথর নিক্ষেপ করলে কয়েকজন ভক্ত আহত হয়। পরে র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) ও বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যরা লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে।”
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় কুমার বসাক সাংবাদিকদের বলেন, “আন্দরকিল্লার মিছিল থেকে জেএমসেন মণ্ডপে হামলার চেষ্টা করা হলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ঘটনাস্থল থেকে ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে।”
ভারতের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজা মণ্ডপে হামলা ও দুর্গা মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “বাংলাদেশে পূজা মণ্ডপে হামলার ঘটনার উপর নজর রাখা হচ্ছে।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “বাংলাদেশে ধর্মীয় স্থানে হামলার খবর আমাদের নজরে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার দ্রুত পদক্ষেপ করেছে তাও আমাদের নজরে এসেছে। সেখানকার প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও পুলিশের ব্যবস্থা করেছে।”
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা শুভেন্দু অধিকারী গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে হামলার ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে ট্যাগ করে টুইট করে বাংলাদেশের এই ঘটনাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন।
শুক্রবার নরেন্দ্র মোদীকে এক চিঠি লিখে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “বাংলাদেশে সনাতনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর দুষ্কৃতিদের হামলা নিয়মিত ঘটে চলেছে।”
বাংলাদেশের হিন্দুদের “সাহায্য করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ” করার আরজিও জানান শুভেন্দু।
এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের সাবেক রাজ্যপাল ও বিজেপি নেতা তথাগত রায় এক টুইটে বলেন, “বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুরা আমাদের অসহায় আত্মীয়। তাই তাদের জন্য এপারে সকলে বড় চিৎকার তুলুন।”
ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
‘সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার প্রভাব দুই দেশের ওপরই পড়ে’
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতের উদ্দেশে বলেন, “ভারত আমাদেরকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছে… সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে তাদেরকেও সচেতন থাকতে হবে।”
“সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে। আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে,” যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী খুবই যথার্থ বলেছেন। কারণ, সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা বাংলাদেশ ভারত যেখানেই হোক না কেন এর প্রভাব দুই দেশের ওপরই পড়ে।”
“সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পেছনে বড়ো ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থও থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তবে “সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা নতুন কিছু নয় বরং এখন যা হচ্ছে তা ধারাবাহিক হামলারই অংশ,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস।
“আমাদের এখানে একটি সাম্প্রদায়িক স্বার্থবাদী গ্রুপ আছে, তারা রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য সাধারণ মুসলমানদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে,” বলেন এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী।
পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু পূজা মণ্ডপে হামলার ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উপর ভারত সরকারের চাপ সৃষ্টি করা দরকার।”
“বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়মিত হয়ে উঠেছে। তাই একসময় যেখানে বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ হিন্দু ছিলেন তা ধারাবাহিক নির্যাতনের ফলে কমতে কমতে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে,” যোগ করেন তিনি।
বসু আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার হিন্দুদের ওপর আক্রমণকারী দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করার জন্য যদি ভারত সরকারের সাহায্য চায়, তবে তা ভারত সরকার নিশ্চয়ই করবে।”
কলকাতা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পরিতোষ পাল।