মণ্ডপে কোরান রাখা ব্যক্তি সন্দেহে গ্রেপ্তার ইকবালকে শনাক্ত করেছেন তাঁর মা
2021.10.22
ঢাকা
কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরান রাখা ব্যক্তি সন্দেহে কক্সবাজারে গ্রেপ্তার ইকবালের পরিচয় তাঁর মা নিশ্চিত করেছেন বলে শুক্রবার জানিয়েছে পুলিশ।
ইকবাল হোসেনকে (৩৫) বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে কক্সবাজার পুলিশ। শুক্রবার তাঁকে কুমিল্লায় নিয়ে আসার পর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম তানভীর আহমেদ শুক্রবার বেনারকে জানান, এই ব্যক্তিই ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরায় ধরা পড়া ইকবাল।
“তাঁর মা আমেনা বেগমও তাঁকে শনাক্ত করেছেন,” বেনারকে বলেন তানভীর আহমেদ।
পূজামণ্ডপে কোরান রাখার কথা ইকবাল স্বীকার করেছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রাথমিক তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই জানানোর উপায় নেই।”
“জিজ্ঞাসাবাদ এখনো চলছে” উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইকবাল পূজামণ্ডপে কোরান রেখেছে কিনা, রাখলে কেন, কার বা কাদের প্ররোচনায় রেখেছে- সেসবই জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
কুমিল্লা পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য আদালতে পাঠানোর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে না। তবে জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল পূজামণ্ডপে কোরান রাখার কথা স্বীকার করেছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুমিল্লার একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে জানিয়েছেন।
গত ১৩ অক্টোবর নানুয়া দিঘীর উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘ আয়োজিত পূজার অস্থায়ী মণ্ডপের হনুমানের প্রতিমার কোলে কোরান পাওয়ার ঘটনায় হিন্দুরা মুসলিম ধর্মগ্রন্থ অবমাননা করেছে অভিযোগ তুলে সেখান থেকেই সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু করা হয়। যা পরে সারাদেশে ছড়িয়ে যায় এবং ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এতে মারা যান মোট আটজন মানুষ।
কুমিল্লার ঘটনাস্থলের আশেপাশের একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে চিহ্নিত ইকবাল বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে গ্রেপ্তার হলে শুক্রবার দুপুরে তাঁকে কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুপুর ১২টার পর তাঁকে পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়।
কুমিল্লা নগরীর সুজানগর এলাকার মাছ বিক্রেতা নূর আলমের ছেলে ইকবাল মাঝেমধ্যে রঙমিস্ত্রি ও নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। ইকবাল দেড় দশক ধরে মাদকাসক্ত বলে তার পরিবারের বরাত দিয়ে জানিয়েছে পুলিশ।
“অনেক খবরে ইকবালকে মানসিকবিকারগ্রস্থ বলা হচ্ছে,” মন্তব্য করে কুমিল্লা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বেনারকে বলেন, “একজন পাগল কীভাবে এত বড়ো একটি ঘটনা ঘটিয়ে কক্সবাজারে পালিয়ে যেতে পারে সেটা আমরা বুঝতে পারছি না।”
“প্রয়োজনে ইকবালকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আরো উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করুক। কারণ, তার পেছনে কে বা কারা ছিল, সেই মানুষগুলোর পরিচয় বের হওয়া জরুরি,” বলেন এই সংখ্যালঘু নেতা।
পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সরবরাহ করা ১৬ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের সিসিটিভি ফুটেজে ইকবালকে কুমিল্লা নগরীর দারোগাবাড়ি এলাকার শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরির মাজারসংলগ্ন মসজিদ থেকে কোরান নিয়ে নানুয়া দিঘীর উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘ আয়োজিত পূজার অস্থায়ী মণ্ডপের দিকে যেতে দেখা গেছে। পরে হিন্দু দেবতা হনুমানের ‘গদা’ হাতে ফিরতে দেখা গেছে তাঁকে, যখন তাঁর হাতে কোরান ছিল না।
পুলিশের ধারণা হনুমানের কোলে কোরান রেখে হনুমানের গদাটি নিয়ে আসেন ইকবাল।
নিহতের সংখ্যা বেড়ে আট
পূজামণ্ডপে কোরান পাওয়াকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার মনোহরপুর এলাকার রাজ রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরে হামলার ঘটনায় প্রথম দিনেই আহত হয়েছিলেন দিলীপ দাস (৭৫)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মারা গেছেন।
দিলীপ ১৩ অক্টোবর থেকে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন জানিয়ে তাঁর মৃত্যুর তথ্য বেনারের কাছে নিশ্চিত করেন ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল খান।
সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক নৈরাজ্যের কারণে এ নিয়ে মোট আটজন মারা গেলেন। এর আগে চাঁদপুরে পাঁচজন এবং নোয়াখালীতে দুইজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে পুলিশ। নিহত মুসলিমদের পাঁচজনই ১৩ অক্টোবর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে পুলিশের “ভিড়ের মধ্যে সরাসরি গুলিবর্ষণ না করে সহিংসতা কমিয়ে আনা দরকার,” বলে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক চাপপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইন প্রয়োগকারীরা “সতর্কতা ও সংযমের সাথে কাজ না করলে” তা সহজেই আরো রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলী খান, রাশেদা কে চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি আব্দুল মতিনসহ ৪৭ বিশিষ্টজন এক যৌথবিবৃতিতে শুক্রবার বলেন, “জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি বর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছে তাতে শক্তিপ্রয়োগ পরিমিত ও আইনানুগ ছিল কিনা তাও তদন্ত করে দেখতে হবে।”
“প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরো সতর্ক, সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল,” উল্লেখ করেন তারা।
একইদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রফেসর ইমেরিটাস আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন, শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী ও সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন আরো ১৪ বিশিষ্টজন এক বিবৃতিতে বলেন, “অতীতে এই ধরনের অনেক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলেও এর কোনো বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।”
ক্ষতিপূরণের দাবি হিন্দুদের
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শুক্রবার বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক হামলায় হিন্দুদের সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে পূরণের পাশাপাশি পূর্ণ নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়।
লিখিত বক্তব্যে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির–বাড়িঘর সরকারি খরচে নির্মাণ, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের দাবি জানান।
এছাড়া শুক্রবারও শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের বিচার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার দাবিতে জানিয়েছে হিন্দুদের কয়েকটি সংগঠন।
এদিকে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) শুক্রবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, এখন পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগে ২০ হাজার ৬১৯ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ১০২ টি মামলা দায়ের হয়েছে।
এদের মধ্যে ৫৮৪ জনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলেও উল্লেখ করা হয় সংবাদে।