হিন্দু ধর্মীয় নেতার জামিন নামঞ্জুর, সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত

জেসমিন পাপড়ি ও মিনহাজ উদ্দিন
2024.11.26
ঢাকা ও চট্টগ্রাম
হিন্দু ধর্মীয় নেতার জামিন নামঞ্জুর, সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নেওয়ার পথে সড়ক আটকে বাধা দেন তাঁর সমর্থক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ২৬ নভেম্বর ২০২৪।
[মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সরকারি এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও আদালতের প্রবেশ সড়কে এ সংঘর্ষ ঘটে।

এর আগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিন না মঞ্জুর হওয়ার পর তাঁকে কারাগারে নেওয়ার সময় তাঁর অনুসারীরা প্রিজন ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়ে সড়ক অবরোধ করেন।

হামলায় নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫) সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) এবং চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন।

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আদালত থেকে বাসায় ফেরার পথে সড়কে আইনজীবী সাইফুলের ওপর হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়।”

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক বেনারকে বলেন, “হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে।”

হামলার এ ঘটনায় আহত আরো ৭-৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আইনজীবীকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশবাসীকে ধৈর্য ধরে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

4.jpeg
চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নেওয়ার পথে বাধা দিলে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। ২৬ নভেম্বর ২০২৪। [মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

জামিন নামঞ্জুর, সংঘর্ষ শুরু

গত সোমবার চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে তাঁকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। চিন্ময় ইসকন (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ) বাংলাদেশের নেতা ছিলেন। গত জুলাই মাসে এই সংগঠন থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দুটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন করে। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে নিউমার্কেট এলাকায় জোটের এক সমাবেশের পর চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপির নেতা ফিরোজ খান। পরে ওই নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি।

মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে চিন্ময়ের অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বেনারনিউজের একজন ফটো সাংবাদিক। তিনি জানান, আদালতের শুনানির পর বেলা সোয়া বারোটার দিকে চিন্ময়কে প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তখন তাঁর সমর্থকরা ভ্যানটি ঘিরে ধরে তাঁর মুক্তির দাবি জানায়। আদালত চত্বর থেকে বের হওয়ার সড়কটিতে পুরাতন পিকআপ ভ্যান দিয়ে পথ রোধ করা হয়। পাশাপাশি বিক্ষোভকারীরা পুলিশের প্রিজন ভ্যানটির চাকা ছিদ্র করে দেয়।

বেলা পৌনে তিনটার দিকে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ফাটিয়ে এবং লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার পর চিন্ময় দাসকে পুলিশের একটি পিকআপে করে আদালত চত্বর থেকে বের নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান তিনি।

ভারত-বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতির পাল্টা জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।

চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উল্লেখ করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এ বিষয়টি কোনো কোনো মহল ভুলভাবে উপস্থাপন করছে, তাতে বাংলাদেশ হতাশা ও দুঃখ বোধ করছে।

ভারতের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ ধরনের বিবৃতি শুধুমাত্র ঘটনাটিকে ভুলভাবেই তুলে ধরছে না, বরং প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্ব এবং বোঝাপড়ার সম্পর্ক রয়েছে, সেই মনোভাবের বিরোধী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ গভীরভাবে বিশ্বাস করে, কোনোরকম ব্যত্যয় ছাড়াই প্রত্যেক ধর্মের মানুষের তাদের ধর্মীয় উৎসব, রীতিনীতি পালনের বা মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। অন্য সব নাগরিকের মতো বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের রক্ষা করা বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। যেকোনো মূল্যে বন্দর নগরীতে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সরকার সেখানে নিরাপত্তা আরো জোরদার করেছে।”

এর আগে চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানায় ভারত। গভীর উদ্বেগ জানিয়ে মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে চরমপন্থীদের দ্বারা হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক হামলার পর এখন এই ঘটনা ঘটল।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পাশাপাশি চুরি ও ভাঙচুর এবং দেবতা ও মন্দির অবমাননার একাধিক নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে।

ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়, “শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে ন্যায্য দাবি উপস্থাপনকারী একজন ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিপরীতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারী-দুষ্কৃতিকারীরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"

2.jpeg
চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নেওয়ার পথে বাধা দিলে ধাওয়া দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। ২৬ নভেম্বর ২০২৪। [মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

দেশি-বিদেশি ইন্ধন দেখছে সরকার

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পেছনে দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে ইন্ধন থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

সিলেট সার্কিট হাউসে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, খেলো যুক্তিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে আটক করা হয়েছে। তাঁর দাবি, যে পতাকা অবমাননার কথা বলা হচ্ছে সেটি বাংলাদেশের পতাকাই ছিল না।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুললেই তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। সাইবার বুলিং করা হচ্ছে।”

মুক্তি দাবি হিন্দু নেতাদের

চিন্ময় দাসকে একদিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে চলমান ‘অহিংস আন্দোলন’ আরও জোরালো করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের নেতারা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ কুমার হালদার বলেন, বুধবারের মধ্যে চিন্ময় দাশকে মুক্তি দেওয়া না হলে সারাদেশে ‘অহিংস আন্দোলন’ আরও বেগবান হবে।”

এই ঘটনার প্রতিবাদে ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের মুক্তি দাবিতে ঢাকার শাহবাগ ও মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়। আরও বিক্ষোভ হয়েছে চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতেও।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।