অর্থনীতিবিদদের মতে পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সাধারণ ক্ষমার উদ্যোগ ‘অনৈতিক’

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.05.27
ঢাকা
অর্থনীতিবিদদের মতে পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সাধারণ ক্ষমার উদ্যোগ ‘অনৈতিক’ ঢাকার গুলিস্তান এলাকার ফুটপাতে বিক্রির জন্য নতুন নোট নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। বাংলাদেশে উপহার হিসেবে নতুন নোটের চাহিদা রয়েছে। ২৫ এপ্রিল ২০২২।
[বেনারনিউজ]

কিছু কর দিয়ে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনলে পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা দেয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ অর্থ পাচার রোধের বদলে পাচারকারীদের আরো উৎসাহিত করবে।

সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে আগামী বাজেটে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তাফা কামাল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এব্যাপারে একটি আদেশ জারি করবে বলে জানান তিনি।

গত এক দশক ধরে বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার বিতর্কিত সুযোগ দিয়ে আসছে সরকার। এই প্রথমবারের মতো পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

আগামী ৯ জুন সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হবার কথা রয়েছে।

‘অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য’ উদ্যোগ

পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা বিষয়ে সরকারের এই উদ্যোগ “নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, “দেশে দুর্নীতি ও অর্থপাচার ঠেকানোর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ও কাস্টমস সার্ভিস বিভাগ রয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এই সকল প্রতিষ্ঠানের কাজ কী?”

এর ফলে দেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার আরো উৎসাহিত হবে দাবি করে এই গবেষক বলেন, দেশের নিয়ম মেনে যাঁরা ৩০ ভাগ কর পরিশোধ করেন তাঁদের প্রতি কি বিচার করা হবে?

পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা বললেও দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে সেব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

তবে আমেরিকা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি গতবছর ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে আট দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সাত লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

অর্থ পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও দায়মুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “এটি আইন এবং দেশের সংবিধান পরিপন্থী।”

“অতীতে আমরা দেখেছি সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। তবে এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তেমন অর্থ আসেনি। এই পদক্ষেপের সুফল রাষ্ট্র পায়নি। কিন্তু ক্ষতি যা হয়েছে তা হলো সমাজে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়েছে। অর্থপাচার বৃদ্ধি পেয়েছে,” বলেন তিনি।

তাঁর মতে, সরকারের এই উদ্যোগের ফলে “কোনো পাচার করা অর্থ ফেরত তো আসবে না বরং ভবিষ্যতে দুর্নীতি ও অর্থপাচার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে।”

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এইভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা না করে সরকার জাতিসংঘ দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনের আওতায় বিশ্বের যে সকল দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে তাদের সাথে একত্রে কাজ করে আইনি সহায়তায় মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে পারে।”

সরকারের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ঘোষণাকে “অনৈতিক, অবিচার ও অগ্রহণযোগ্য,” হিসেবে আখ্যায়িত করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শুক্রবার বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্র ব্যবস্থাই দুর্নীতিবাজদের বছরের পর বছর ধরে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ করে দিয়েছে। এবার অর্থ পাচারকারীদের দায়মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।”

দেশের বর্তমানে রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেউই পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনবে না বলে মনে করেন বদিউল।

“পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। টাকা ফেরত আনলে কারা টাকা পাচার করেছেন সেটি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে ওই সকল অর্থ পাচারকারীদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশে অর্থপাচার গুরুতর অপরাধ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে, “যাঁরা অর্থ পাচার করেছে তারা সরকারের ঘনিষ্ঠ। ঘনিষ্ঠ না হলে সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর পাচারকারীদের যারা তাদের অর্থ ব্যাংকে না রেখে ট্রাঙ্কে ভরে রেখেছে সেগুলো দেশে পাঠাবেন।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, যদি পাচারকৃত অর্থ ফেরানো করের হার বৈধ পথে পাঠানো টাকার চাইতে কম হয় তাহলে যাঁরা বৈধ পথে টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন; তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন।

তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার হওয়ার বিভিন্ন কৌশল ও উপায় রয়েছে। কোন কোন ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হওয়া পণ্যের দাম কম কমিয়ে হিসাব দেখিয়ে ওই মূল্যের একটি অংশ বিদেশের ব্যাংকে রেখে অল্প পরিমাণ টাকা দেশে আনেন। আবার অনেকে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বাড়তি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করেন।

এছাড়া অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ দেশের হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পাচার করেন বলেও জানান তিনি।

কীভাবে টাকা পাচার হচ্ছে সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে পর্যালোচনা না করে শুধু পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেই দেশে টাকা চলে আসবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে আমদানির পরিমাণ হবে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে রপ্তানি থেকে সর্বোচ্চ আয় হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং প্রবাসীদের রেমিটেন্স আসবে সর্বোচ্চ ২০ বিলিয়ন ডলার।

সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশের আয় হবে ৭০ বিলিয়ন ডলার এবং ব্যয় হবে ৮৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান থাকবে ১৫ বিলিয়ন ডলার।

সাম্প্রতিক মাসগুলো আমদানির পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগের বেশি বৃদ্ধি পাওয়া এবং শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা শেষ হয়ে জন অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে সরকার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আপাতত বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

একইসাথে গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিছু কিছু বিলাস সামগ্রীর ওপর বাড়তি শুল্ক বসানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

আন্তর্জাতিক বৈশ্বিক অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়নের পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের সংজ্ঞা অনুসারে বিভিন্ন অপরাধী কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের অবৈধ উৎস লুকিয়ে সেই অর্থকে বৈধ করার প্রক্রিয়াকেই মোটাদাগে অর্থপাচার বলা হয়।

বাংলাদেশেও অর্থপাচার গুরুতর অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী, দেশের টাকা যেকোনো অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে পাচার করলেই তা মানি লন্ডারিং হিসাবে বিবেচিত হবে। এই অর্থপাচারের সাজা সর্বনিম্ন চার বছর থেকে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও আর্থিক দণ্ড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।