জন্ম শতবর্ষে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান

মাহবুব লীলেন
2020.03.17
ওয়াশিংটন ডিসি
200317_mujib_1000.jpg বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা, ৩ মার্চ ১৯৭১।
[এপি]

বাংলাদেশে শুরু হয়েছে মুজিব বর্ষ। ১৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর দিন থেকে আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময়কে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসাবে ঘোষণা করেছে সরকার।

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার সূচনা হয়েছে মুজিব বর্ষের।

মঙ্গলবার রাত আটটায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামে শুরু হয় শততম জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে জনসমাগম এড়াতে পুরো অনুষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করা হয়। আতশবাজি ছাড়া সব অনুষ্ঠানই ছিল আগে থেকে রেকর্ডকৃত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির আয়োজনে মুক্তির মহানায়ক শিরোনামে দেশের সব টেলিভিশনে এটি সম্প্রচার করা হয়।

এ দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দেওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। করোনাভাইরাসের কারণে পুরো অনুষ্ঠান পুনর্বিন্যাস করায় তাঁর ঢাকা সফরসূচি পরিবর্তন করা হয়। ভিডিও বার্তায় তিনি বক্তব্য দেন।

নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আরও চার বিদেশি অতিথি ভিডিও বার্তা দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাঁরা হলেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ বিন আহমেদ আল-ওথাইমান।

 

 

এক নজরে শেখ মুজিবুর রহমান

ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন।

ওই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে তিনি উদারপন্থী সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।

পঞ্চাশের দশকে শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন। হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৩ সালে তিনি এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি মন্ত্রী হন শেখ মুজিব। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ‌মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্বের কট্টর সমালোচক।

লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা হিসেবে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের পক্ষ থেকে এক গণ সংবর্ধনায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷

ঢাকার এক জনসভায় ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা দীর্ঘায়িত করতে থাকেন।

এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ওই ভাষণটি ২০১৭ সালে ইউনেসকোর ডকুমেন্টারি ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযান শুরু হয়। ২৬ মার্চ ঢাকায় গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের আগে এক টেলিগ্রাম বার্তার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি।

গ্রেপ্তারের পর তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকেন।

২৬ মার্চ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবার পর করাচি বিমানবন্দরে পাকিস্তানি নিরাপত্তারক্ষীদের পাহারায় শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ এপ্রিল ১৯৭১।
২৬ মার্চ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবার পর করাচি বিমানবন্দরে পাকিস্তানি নিরাপত্তারক্ষীদের পাহারায় শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ এপ্রিল ১৯৭১।
[এপি]

শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারে তাঁকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক হিসাবে, নয় মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১২ জানুয়ারি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পদ্ধতি চালু করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

বাংলাদেশের গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর দেশের প্রথম সংবিধান পাশ করে, এতে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব দেশের সব রাজনৈতিক দলকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা ‘বাকশাল'। একই সাথে অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে পুনরায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‍মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তার এক সামরিক অভ্যুত্থানে ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সাথে নিহত হন শেখ মুজিব।

সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নিষ্পেষিত বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য শেখ মুজিব তাঁর ৫৫ বছর জীবনের প্রায় ১১ বছরই জেলে কাটিয়েছেন বলে ২০১৭ সালে সংসদে এক বক্তৃতায় জানান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও বঙ্গবন্ধুর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ।

শেখ মুজিবের বড়ো মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি বর্তমানে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।