৩২ নম্বরে শোক পালনে বাধার মুখে আওয়ামী লীগ

অয়ন আমান
2024.08.15
ঢাকা
৩২ নম্বরে শোক পালনে বাধার মুখে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তাঁর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ছাত্র-জনতার হামলার মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ১৫ আগস্ট ২০২৪।
[জীবন আহমেদ/ বেনারনিউজ]

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৫ আগস্টে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হামলা ও বাধার মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এলাকায় গেলে ছাত্র-জনতার হামলায় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন।  শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া কয়েকজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি বাতিল করে, যা গত এক যুগের বেশি সময় ধরে পালন করা হচ্ছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একদল সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছিলেন।  সেই সময় থেকে দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছিলো আওয়ামী লীগ।

২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।

ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগের পর ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শোক দিবস পালনের আহ্বান জানান।

আপনাদের কাছে আবেদন জানাই যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ভাবগম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট পালন করুন। বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন,” জানান হাসিনা।

দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির ঘোষণা ছিলো না।

তবে সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে যারা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাদের কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানান ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমরানুল ইসলাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “কয়েকজন আহত হয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা প্রায় দশ জনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে।”

এই বিষয়ে এখনও মামলা দায়ের করা হয়নি জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশ তথ্য পেয়েছে যে বিশৃঙ্খলার সময় বিক্ষোভকারীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মোবাইল ফোন চেক করেছে।”

শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানানো থেকে বাঙালি জাতিকে বঞ্চিত করার বিষয়টি একটি মন্দ দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

তিনি বেনারকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীর দিনে সেখানে মানুষ যাবেন,  শ্রদ্ধা জানাবেন-সেই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা ঠিক হয়নি।”

শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি কাদের সিদ্দিকী

এ দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে না পেরে ফিরে যান কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী।  সেখানে বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়িতেও হামলা চালায়।

আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রধান ভুল ছিল তারা ১৬ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেও বঙ্গবন্ধুকে (শেখ মুজিবুর রহমান) জাতির পিতা বানাতে পারেনি।  ওরা তাঁকে শুধু আওয়ামী লীগের করেছে,” বেনারকে বলেন কাদের সিদ্দিকী।

দেশের এই পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে তিনি বলেন, “আমি সেখানে অনেক উত্তেজিত লোক দেখেছি, ছাত্রদের দেখেছি।  তারা আমাকে বললো, আপনি চলে যান, আমি চলে গেলাম।  আমার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।  তবে যারা আমার সাথে কথা বলেছে তারা ভালো আচরণ করেছে।”

দ্রুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান কাদের সিদ্দিকী।

এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন সংস্কৃতি কর্মী রোকেয়া প্রাচী।  ফেরার পথে হামলার স্বীকার হন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এই ঘটনাগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বলে মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

তিনি বেনারকে বলেন, “ওখানে আওয়ামী লীগসহ যেকোনো নাগরিক তারা যদি যেতে চান, শোক জানাতে চান, এটা একটা স্বাভাবিক সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার। কোনো যুক্তি দিয়ে এই অধিকার হরণ করার, ক্ষুণ্ন করার কারো কোনো সুযোগ নেই।  আমরা এগুলো দেখতে চাই না।”

দায় অস্বীকার ছাত্রদলের

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিরুদ্ধে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাছির।

তিনি বেনারকে বলেন, “দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জুলাইয়ের বিক্ষোভে ছাত্র-জনতা হত্যায় শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচারের দাবিতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে আমরা ব্যস্ত।ছিলাম।  ধানমণ্ডিতে আমাদের কেউ যায়নি।”

মানুষের ফোন চেক করে হেনস্তা করা যাবে না

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, “আজকের ‘সর্বাত্মক অবস্থান’ কর্মসূচিতে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ফোন চেক করে হেনস্তা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন স্পষ্ট করে বলতে চায়, মানুষের প্রাইভেসি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কিছু আমরা সমর্থন করি না।”

“‍এমন কাজ পুরোনো বৈষম্যের দৃষ্টান্তকেই আবার নতুনভাবে ডেকে আনছে। তাই ফোন চেকসহ নাগরিকের ব্যক্তি জীবনের স্বাভাবিক যাত্রা বিনষ্ট হয় এমন কিছুই করবেন না। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের পথে ‌‍‌মা‌নুষের ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ,’’ বলেন তিনি।

সকলের উদ্দেশ্যে রিফাত রশিদ বলেন, “সারাদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দিতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিন এবং স্বাভাবিক জনজীবন যাতে আরও সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হয় তা নিশ্চিতে রাজপথে থাকুন।”

বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আরও অভিযোগ করেছেন, বিক্ষোভকারীরা যারা বাঁশের লাঠি, লোহার রড এবং পাইপ নিয়ে সজ্জিত ছিল, তারা হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হামলার সময় ছবি বা ভিডিও ধারণ না করতে বলেছিল।

হাসিনার বিরুদ্ধে আরো মামলা

বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।  এই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ছয়টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শাহাবুদ্দিন নামে এক অটোরিকশাচালকের মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আবুল কামাল নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

ওই মামলাটি গ্রহণের জন্য বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম ফারাহ দিবা ছন্দা শেরেবাংলা নগর থানাকে নির্দেশ দেন।

গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় হাসিনাসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গ্রহণের জন্য মোহাম্মদপুর থানাকে নির্দেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী।

মামলার এজাহারে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে র‌্যাবের গুলিতে জোবায়েদ হোসেন ইমন (১২) নিহত হন।

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন শেখ হাসিনা।

ওই ট্রাইব্যুনালে বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়।

বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলাকালে হত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।