মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই, বাংলাদেশে নিহত দুই
2024.02.05
নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান
মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেল বিস্ফোরণে সোমবার বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুজন নিহত হয়েছেন, যাদের একজন রোহিঙ্গা পুরুষ, অন্যজন বাংলাদেশি নারী।
গত সপ্তাহ থেকে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের ছোড়া অসংখ্য গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়। তবে প্রাণহানির সংখ্যা এই প্রথম।
পুলিশ জানিয়েছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী সীমান্তে সোমবার দুজন নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হয়েছেন আরও দুজন। এর আগে রোববার মিয়ানমারের দিক থেকে আসা গুলিতে তিন বাংলাদেশি আহত হন।
এদিকে আরাকান আর্মিসহ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হামলা থেকে বাঁচতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন।
রোববার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত বিজিপির অন্তত ১০৩ সদস্য বাংলাদেশে এসেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তারা।
মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষের জেরে দেশটির বিজিপি সদস্যরা অস্ত্রসহ বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন বলে বেনারকে জানান বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বিজিবি তাঁদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নেবার পর তাঁদের মধ্যে আহত ২৪ জনকে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে কয়েকশ সৈনিক পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেবার পর তাঁদের বিমানযোগে ফেরত পাঠিয়েছে ভারত। তবে বাংলাদেশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের প্রবেশের ঘটনা এবারই প্রথম।
মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় নিহত দুজন
মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশে দুজন নিহত হওয়া ছাড়াও ইব্রাহীম ও আব্বুয়াই নামে আরো দুইজন আহত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান।
তিনি বলেন, নিহতদের একজন জলপাইতলী সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা বাদশা মিয়ার স্ত্রী হুসনে আরা (৫০)। অপরজন রোহিঙ্গা শরণার্থী নবী হোসেন (৬৫)। ঘটনার সময় বাদশা মিয়ার বাড়িতে কাজ করছিলেন নবী। আহতদের বিস্তারিত পরিচয় পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
নিহত হুসনে আরা'র ভাই শাহ আলম বেনারকে জানান, “সকাল থেকে সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি চলছিল। দুপুরের দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ে আমার বোনের বাড়িতে। এতে বোনসহ দুজন মারা গেছে। এর মধ্য একজন রোহিঙ্গা ছিল। আমরা ভয়ে আছি. কখন কী হয় তা ভেবে।”
নিহত রোহিঙ্গা নবী হোসেনের লাশ নিতে এসে তাঁর ছেলে ইমাম হোসেন বেনারকে বলেন, তাঁর দিনমজুর বাবা সোমবারও প্রতিদিনের মতো কাজের সন্ধানে বের হন। হঠাৎ তাঁরা খবর পান যে মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে তিনি মারা গেছেন।
তিনি বলেন, “২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে প্রাণ বাঁচাতে আমরা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এরপরও শেষ রক্ষা হলো না। শেষমেশ মিয়ানমারের মর্টার শেলেই মারা গেল আমার বাবা। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?”
বাংলাদেশের বসতবাড়িতে বিস্ফোরণে দুজন নিহতের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। একই সঙ্গে পালিয়ে আসা জান্তা সরকারের সীমান্তরক্ষীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে সাংবাদিকদের জানান বিজিবির কক্সবাজারের আঞ্চলিক কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম। সোমবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
বিজিপি সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে যোগাযোগ
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে আসা বিজিপির সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার।
“বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ও দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছেন যে, তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের ফিরিয়ে নেবে,” জানান হাছান মাহমুদ।
তবে কোন পথে কীভাবে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এর আগে ভারতীয় ভূখণ্ডেও ঢুকেছিলেন, তাঁদের আকাশপথে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আমরাও তাদের ফেরত পাঠাব।”
সরেজমিন ঘুমধুম সীমান্ত
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গত সপ্তাহ ধরে নতুন করে জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে।
গত রোববার ও সোমবার সরেজমিন সীমান্তে বসবাস করা অন্তত আটজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওপারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংঘাত ও গোলাগুলি চলছে। কিন্তু গত তিন দিন ধরে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, মর্টার শেল ও বিরামহীন গোলাগুলির শব্দে ঘুম নেই সীমান্তের কয়েক হাজার বাসিন্দার। বন্ধ রাখা হয়েছে স্থানীয় পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা। স্থানীয়দের কাজকর্ম বন্ধ, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
“সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান দেখা গেছে। এছাড়া থেমে থেমে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। প্রাণভয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি,” বেনারকে বলেন ঘুমধুমের জলপাইতলী সীমান্তের বাসিন্দা মমতাজ বেগম।
প্রতিনিয়ত ঘরবাড়িতে গুলি এসে পড়ায় সীমান্ত এলাকার অনেকেই অন্যত্র চলে যাচ্ছে বা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে বলে বেনারকে জানান ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একে এম জাহাঙ্গীর আজিজ ও তুমব্রু সীমান্তের স্থানীয় চৌকিদার আবদুল জব্বার।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এর বড়ো একটা অংশই পড়েছে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি জোরালো অভিযান শুরু করেছে আরকান আর্মিসহ দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। ফলে দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকাগুলোতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে।
মিয়ানমারে যেখানে এসব সংঘাত চলছে, তা বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত। ফলে তুমব্রু ও টেকনাফ সীমান্তে এরই মধ্যে সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, “আমরা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সীমান্তে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে অন্যত্রে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছি। সব সংস্থা মিলে সীমান্তের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
গত অক্টোবরে আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনী বিরোধী সশস্ত্র জোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে ব্যাপকতর লড়াইয়ে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়। তারা ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দৌরাত্ম্যে চাপে থাকা সেনাবাহিনীর ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু করে।
এরপর গত ১১ সপ্তাহে চীনের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অংশে জোটের হাতে পর্যুদস্ত হয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সর্বশেষ গত শনিবার দেশের আরেক প্রান্তে ভারত-ঘেঁষা পালেতোয়া শহরের মিওয়া ঘাঁটির শেষ সেনাচৌকিটি দখলে নেয় আরাকান আর্মি।
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় কয়েকশ মানুষ
সীমান্তবর্তী স্থানীয়রা বেনারকে জানান, ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন দেশটির কয়েকশ নাগরিক, যাদের বেশিরভাগই চাকমা ও রোহিঙ্গা।
তবে সীমান্তের ওপারে কতজন অপেক্ষমাণ রয়েছেন সেটি জানা নেই বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে।
“আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে আমাদের অনুরোধ সেদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে মানবিক সহায়তায় প্রদান করা হোক, যাতে তাদের এদেশে না আসতে হয়। এমনিতেই আমরা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে চাপের মুখে রয়েছি,” বলেন মিজানুর রহমান।
সোমবার দুপুরের দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া পয়েন্টে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে বাধা দেয় বিজিবি। তবে এ বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুতদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সোমবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরসনে জাতিসংঘ এবং চীনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ঘটনাস্থলের আশেপাশে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। ওই দেশের ভেতর থেকে ছোড়া মর্টারের শেল পড়ছে আমাদের সীমান্তে। আবার তারা আকাশসীমাও লঙ্ঘন করছে, তাদের নিজেদের সমস্যার কারণে আমরা সমস্যার সম্মুখীন হব কেন?