মিয়ানমার পরিস্থিতি: শরণার্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে ভারত-বাংলাদেশ
2024.02.07
ঢাকা, কক্সবাজার ও কলকাতা
মিয়ানমারে জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পড়ায় বাংলাদেশ ও ভারত শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত বলেছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের পুরোটাই বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে।
মঙ্গলবার ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজের এক্স প্রোফাইল (সাবেক টুইটার) থেকে এক বার্তায় জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে এক হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার এলাকায় বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
“বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সীমান্তে চলবে টহলদারি। গোটা সীমান্তের মধ্যে মণিপুরে ইতোমধ্যে ১০ কিলোমিটার এলাকায় তারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। আরও ২০ কিলোমিটার বেড়া দেওয়ার কাজ শিগগির শুরু হবে,” লেখেন অমিত শাহ।
এদিকে বুধবার বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকা সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে এদিন তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন।
চলমান সংঘর্ষের কারণে এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিজিবি প্রধান বলেন, “আমাদের সাধারণ জনগণের জন্য জায়গাটা নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যখন গোলাগুলি শুরু হয়, সেই সময়টুকু তো একেবারেই নয়।”
নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকাটা আদৌ সুখকর নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবুও এ ধরনের পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই।
তুমব্রু ও ঘুমধুমের আশপাশের এলাকার সীমান্ত এলাকায়ও সংঘাতের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে এখনই সীমান্তবর্তী এলাকার সবাইকে সরে যাওয়ার কথা বলছি না।”
গত দুই দিনের তুলনায় গোলাগুলির পরিমাণ একটু কম বলে জানান আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, “মিয়ানমার জানিয়েছে, এখানে যারা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিয়ে যেতে প্রস্তুত তারা। যত দ্রুত সম্ভব আমরা নিয়ে যেতে বলেছি।”
তবে বাংলাদেশের আর কোনো অনুপ্রবেশকারীকে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, শুধু মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী নয়, কিছু রোহিঙ্গা “উচ্ছৃঙ্খল” যুবককেও আটক করা হয়েছে। এছাড়া, এখন পর্যন্ত ৭৫ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে টেকনাফ পয়েন্ট থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশে মিয়ানমারের আরো ৬৪ জন সীমান্তরক্ষী
জীবন বাঁচাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্ষ্যংয়ের উত্তরপাড়া সীমান্ত দিয়ে বুধবার দুপুরে মিয়ানমার থেকে আরও ৬৪ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এই নিয়ে এ পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়াল ৩২৮ জন।
মিয়ানমার থেকে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সবাইকে নিরস্ত্র করে হেফাজতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ভাষাগত সমস্যা থাকায় আমরা সবার পরিচয় সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছি তাতে প্রায় সবাই মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের সঙ্গে যুক্ত।”
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বিজিপির এত সংখ্যক সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলে বেনারকে জানান সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “সাধারণ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্য পালিয়ে আসার বিষয়টি এক রকম নয়। তবে এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করে।”
এমন পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই কেবল পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে আশ্রয় প্রার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
“আমরা একবার উদারভাবে সীমান্ত খুলে দিয়েছিলাম। এখন সেই উদারতা দেখানোর আর কোনো সুযোগ নেই। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক যে সাহায্য ছিল, সেটা অনেক কমে গেছে। এমন অবস্থায় এই বোঝা আমরা আর কতদিন বইব,” প্রশ্ন রাখেন কাদের।
তিনি আরও বলেন, এটা মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যা। আরাকান আর্মি তাদের দেশের সমস্যা। তাদের ইন্টারনাল বিষয় নিয়ে তারা কী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।
আতঙ্কিত সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা
বুধবার সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের বিরতিহীন লড়াই চলছে। টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্ষ্যংয়ের উত্তরপাড়া, লম্বাবিল, উলুবনিয়া, জিম্মখালী ও নয়াবাজার সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেল ও গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা।
তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় তুমব্রু, ঘুমধুম ও উখিয়া সীমান্ত এলাকায় গুলির শব্দ কম শোনা গেছে।
উখিয়ার পর এবার টেকনাফ সীমান্ত এলাকা প্রভাবিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহীন শাহ। তিনি বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বোঝা মুশকিল। মিয়ানমার সীমান্তের যুদ্ধ উত্তর দিকে এগোচ্ছে। ফলে এখন আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দারা আতঙ্কে জীবন যাপন করছেন।”
টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বেনারকে বলেন, “সীমান্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তাই আমরা সীমান্তবর্তী মানুষদের সতর্ক থাকতে বলেছি।”
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বেনারকে জানান, “অনুপ্রবেশ রোধে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।”
ভারত সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ
মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মণিপুরের বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন।
মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড সরকারও সীমান্তে বেড়া দেওয়ার ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছে।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পরে নাগাল্যান্ডের উপমুখ্যমন্ত্রী ওয়াই প্যাটন আইজলে সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নাগাদের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তাঁর মতে, এতে আদিবাসীদের সমাজ ও সংস্কৃতি বিভাজিত হবে। সীমান্তের দুই পাশে আদিবাসী নাগা, কুকি ও জোদের বসবাস বহু যুগ ধরে।
মণিপুরের দ্য ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল ফোরাম ও মিজোরামের নাগা গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড ইতোমধ্যে আন্দোলন শুরু করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সাধারণ সম্পাদক কিরীটি রায় বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া অর্থহীন সিদ্ধান্ত। এটি মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। সীমান্তের দুই পাশে এই অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত যে মিল রয়েছে তা বেড়া দেওয়ার কারণে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তেও আমরা ভারতের মতো একই ঘটনা দেখেছি।
মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে।
এর আগে গত জানুয়ারিতে মিয়ানমারের কয়েকশ সেনা সদস্য ভারতে আশ্রয় নেয় এবং বিমানযোগে তাঁদের ফেরত পাঠায় ভারত।
গত ২০ জানুয়ারি এনডিটিভি জানায়, মিয়ানমারের প্রায় ৬০০ সেনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সবাইকে বিমানযোগে ফেরত পাঠানো হয়েছে।