কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা
2024.02.09
বান্দরবান ও কক্সবাজার
বিদ্রোহীদের ত্রিমুখী আক্রমণে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না বলে শুক্রবার বেনারকে জানিয়েছেন তাঁদের এক দোভাষী।
মিয়ানমার থেকে আসার বিজিপি সদস্যদের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন টেকনাফের মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
মিয়ানমার থেকে আসা ৩৩০ বিজিপি সদস্যের মধ্যে ১৬৪ জনের সঙ্গে বিজিবি কথা বলার সময় সাইফুল উপস্থিত ছিলেন। তিনি বেনারকে বলেন, আত্মসমর্পণকারী সৈন্যরা বলেছেন, তাঁরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী।
সাইফুলের বাড়ি হোয়াইক্ষ্যং ফাঁড়ির পাশেই। তাঁর বাড়িতে বসে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সাইফুল জানান, বিজিপির কর্মকর্তা ও সিপাহিরা বলেছেন, ৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টায় বিদ্রোহীরা আক্রমণ শুরু করার পরদিন তাঁরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
“দুই দিন তাঁরা প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন। বিদ্রোহীদের হাতে তাঁদের ১০ জন নিহত হন। আরাকান আর্মির ২০ জন নিহত হয়েছেন বলেও তাঁরা দাবি করেছেন,” বলেন সাইফুল।
বিজিপি সদস্যদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আটকে দিয়ে আমাদের তাঁরা ঘিরে ফেলে। হামলা চালায়। যে কারণে আমরা এদিকে (বাংলাদেশে) পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।”
সাইফুল মোট যে ১৬৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৭ জন কর্মকর্তা পর্যায়ের ছিলেন বলে জানান তিনি।
“তারা প্রায় সবাই বর্মী, তবে কয়েকজন রাখাইনও আছেন। বিজিবি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিস্তারিত জানতে আমি তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেছি। তবে তাঁরা খুব বেশি জবাব দিতে চান না। তাদের একটাই কথা, আমাদের ওপর হামলা হয়েছে, তাই আমরা পালিয়ে এসেছি,” জানান সাইফুল।
কবে, কোন পথে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে কয়েকজন বিজিপি সদস্য তা জানতে চেয়েছেন বলেও জানান সাইফুল।
গত ৪ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে আসা ৩৩০ জন বিজিপি সদস্যের মধ্যে বাকি ১৬৬ জনের সঙ্গে বিজিবির দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন উখিয়ার বাসিন্দা আবদুল করিম। তবে বিজিবির অনুমতি ছাড়া তিনি বেনারকে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।
বিজিবির কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমানের কাছে অনুমতি চাওয়া হলে শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “দোভাষী করিম বিজিবির কেউ নন, যে কারণে আমরা তাঁকে এই অনুমতি দিতে পারি না।”
বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলামও বেনারকে বলেন, “এসব বিষয়ে তাঁর কথা বলার এখতিয়ার নেই।”
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গত সপ্তাহে বিজিপি সদস্যের সঙ্গে দেখা করার সময়ও করিম দোভাষী হিসেবে ছিলেন।
সেদিন ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিজিবি প্রধান সাংবাদিকদের জানান, মানবিক ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতির কারণে এবং (মিয়ানমারের সঙ্গে) সুসম্পর্ক রাখতেই বিজিপি সদস্যদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের আঞ্চলিক কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, চলমান সংঘর্ষে বিদ্রোহীদের সঙ্গে পেরে না উঠে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা বিজিপি সদস্যদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
বুধবার পর্যন্ত মিয়ানমারের ৩৩০ সেনা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিজিবির কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। তাঁরা বিজিবির তত্ত্বাবধানে আছেন।
অনুপ্রবেশের চেষ্টায় চাকমা ও রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ চাকমা ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরাও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। শত শত মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশ কোনোভাবেই মিয়ানমারের লোকজনকে আশ্রয় নিতে দেবে না।
২ টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে লোকজন অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু আমরা নতুন করে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না।”
শুক্রবার “১৩৭ জনকে প্রতিহত করা হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, অন্য দিনের তুলনায় এদিন সীমান্ত শান্ত ছিল।
এদিকে মিয়ানমারের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সপ্তাহে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাঁদের সৈন্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী, সৈন্যদের সমুদ্রপথে প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
কাছেই গুলির শব্দ, কুকুরে খাচ্ছিল মরদেহ
বৃহস্পতিবার দিনভর সীমান্তে কোনো গুলির শব্দ পাওয়া না গেলেও সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন সীমান্তে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়। রাত ৮টার দিকে রহমতের বিল এলাকায় একটি মরদেহ পড়ে থাকার কথা জানতে পারেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ক্যামেরার মাধ্যমে মরদেহের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে বেনার। মরদেহটি বাঁধের ঢালে দেখা গেছে। সে সময় একটি কুকুর মরদেহটি টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
এদিন দুপুর ১টার দিকে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করতে যায়। তখন সীমান্তের কাছেই থেমে থেমে গুলি চলছিল। দুপুর ৩টার দিকে মরদেহ উদ্ধার না করেই ফিরে যায় পুলিশ। বিজিবি সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত মরদেহটি শনাক্ত বা উদ্ধার করেনি কেউ।
“পরিস্থিতি শান্ত হলে” লাশটি উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন।
রহমতের বিল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ জয়নাল বেনারকে বলেন, “ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এটা কার লাশ। তবে বাঁধের ওপাশে আরও লাশ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
বেনার প্রতিনিধিরা বৃহস্পতি ও শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও বেতবুনিয়া এবং কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী, রহমতের বিল, টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং, পুরানপাড়া, জিম্মংখালী, উনচিপ্রাং, হ্নীলার কাস্টমস ঘাট ও পুরান বাজার সীমান্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন।
গতকাল কাস্টমস ঘাট ও পুরান বাজার সীমান্তে এবং শুক্রবার রহমতের বিল ও ঘুমধুম সীমান্তে গুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
আগের দিন দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর পশ্চিমকূল থেকে উদ্ধার করা অবিস্ফোরিত একটি মর্টার শেল শুক্রবার নিষ্ক্রিয় করেছে বিজিবি ও সেনাবাহিনী।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জীবন আহমেদ।