রাখাইনে গোলাগুলি: বাংলাদেশ সীমান্তের অধিবাসীরা আতঙ্কে
2022.09.06
ঢাকা ও কক্সবাজার
দুদিন বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার স্থানীয় জনগণ ও শূন্যরেখা বরাবর বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
এর আগে রোববার বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওই একই ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়ে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে এমন দুটি ঘটনা ঘটল।
উভয় ঘটনায় ঢাকাস্থ মিয়ানমার রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মো‘কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয় এবং এসব ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের ভাষ্য, মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে তুমব্রু সীমান্তে থেমে থেমে ভারী গুলিবর্ষণের বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছেন তাঁরা। এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ।
তাঁরা বলছেন, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রেজু আমতলী, বাইশ ফাঁড়ি এলাকায় থেমে থেমে গুলি বর্ষণ অব্যাহত থাকে। তবে কোনো ধরনের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ভয়ে স্থানীয় মানুষ
তুমব্রু সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদুল হক বেনারকে জানান, “দুই দিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আবারো সকাল থেকে ভারী গুলি বর্ষণ হচ্ছে। ফলে গুলির বিকট শব্দে এখানকার মানুষজন ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে।”
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বেনারকে জানান, “সীমান্তে দুই দিন গুলি বর্ষণ বন্ধ থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়েছে। ফের ভয়ের মধ্যে আছে সীমান্তের লোকজন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।”
এ ব্যাপারে বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম তারিক বেনারকে জানান, “সীমান্তে আবারও গোলাগুলির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভয়ভীতির কোনো কারণ নেই। আমরা সীমান্তে সর্তক অবস্থানে রয়েছি।”
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি বেনারের কাছে স্বীকার করেছে।
প্রায় ২৫ দিন থেমে থেমে সীমান্তে এ ধরনের পরিস্থিতি চলছে।
যোগাযোগ করা হলে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “রাখাইনে কী ঘটনা ঘটছে সেব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমাদের এখান থেকে কিছু জানার উপায় নেই।”
এব্যাপারে ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাসে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
আতঙ্কে শূন্য রেখার রোহিঙ্গারা
গত পাঁচ বছর ধরে ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখায় বসবাস করে আসছেন চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
সম্প্রতি মর্টার শেল ছোড়ার পাশাপাশি গুলি বর্ষণের ঘটনায় নো ম্যানস-ল্যান্ডের থাকা রোহিঙ্গারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
ওই সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমারের অংশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বয়োজ্যেষ্ঠ আবদুল মালেক জানান, “গোলাগুলি বন্ধ না হওয়ায় আমাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। মাঝখানে দুইদিন গোলাগুলি ছিল না।”
তিনি বলেন, “কিন্তু আজকে (মঙ্গলবার) সকাল থেকে আবারও কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ রাউন্ড গুলির শব্দ শুনেছি আমরা। যে কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের নারী, পুরুষ ও শিশুসহ সবার মাঝে ভীতি বিরাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, “মিয়ানমার প্রতিদিন এভাবে গুলি ছুঁড়তে থাকলে রোহিঙ্গারা ‘নো ম্যানস-ল্যান্ড’ ছেড়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাব।”
অন্য এক রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “এখন রাতেও মাঝে মধ্যে গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এতে ক্যাম্পজুড়ে এক অন্যরকম ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারে আমরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে আমরা যাব কোথায়?”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় সেদেশের সামরিক বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী।
সেই সময়ও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমার। বাংলাদেশের বার বার প্রতিবাদ সত্ত্বেও আকাশসীমা লঙ্ঘন অব্যাহত রাখে মিয়ানমার বাহিনী।
অনেকেই এই ঘটনাকে উসকানি বলে মন্তব্য করলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
‘উসকানিমূলক নয়’
গতবছর ফেব্রুয়ারি এক সামরিক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সূ চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে সূ চি সরকারের পক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়েছে তাঁর দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী। তাঁদের বিরুদ্ধেও সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে জান্তা সরকার।
তবে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক গোলাগুলির ঘটনাকে উসকানিমূলক নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ।
তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি না যে মিয়ানমার বাংলাদেশকে উসকানি দিচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে।”
“গোলাগুলি চলছে মিয়ানমার অংশে। সুতরাং, এটি উসকানিমূলক নয়,” বলেন মুনশি ফায়েজ।
ভারত সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও রাখাইনে চলমান সংঘাত নিয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেছেন। সোমবার ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে উদ্ধৃত করে জানান হয়, রাখাইনে অস্থিতিশীলতা কারও জন্য ভালো হবে না।