বিদেশি কূটনীতিকদের মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি অবহিত করল বাংলাদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.09.20
ঢাকা
বিদেশি কূটনীতিকদের মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি অবহিত করল বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারের সঙ্গে চলমান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা ব্রিফিংয়ে ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে]

গত এক মাস ধরে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার বাহিনীর গোলাগুলিতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হতাহতের ঘটনা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা নিরসনে সোমবার প্রথমবারের মতো আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. খুরশেদ আলম।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বান্দরবান জেলার তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় গত দুই সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গোলাবারুদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গোলার আঘাতে শুক্রবার সেখানে এক রোহিঙ্গা যুবক প্রাণ হারিয়েছেন এবং আরও অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে দফায় দফায় বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি বন্ধ হয়নি। বরং সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে এবং সেখান থেকে মানুষদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

মঙ্গলবার নতুন করে কক্সবাজার জেলার উখিয়া সীমান্তে গোলাগুলি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

এই প্রেক্ষাপটে কূটনীতিকদের অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ দেয়া হলেও ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের কোনো প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত হননি। বিষয়টিকে কূটনৈতিক “শিষ্টাচার বহির্ভূত” হিসাবে অভিহিত করেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তাঁদের মতে, এই সভায় উপস্থিত না হয়ে বাংলাদেশকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন, যার অর্থ হলো বেইজিং মিয়ানমারের পাশে রয়েছে।

এ ব্যাপারে চীনা সরকারের বক্তব্য চেয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসে ই-মেইল করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

কূটনৈতিক বিফ্রিং

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মঙ্গলবার কূটনৈতিক এই ব্রিফিংয়ে আসিয়ানভুক্ত দেশ ছাড়া অন্যসব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন খুরশেদ আলম।

চীনা সরকারের প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেননি।

ব্রিফিংয়ের পর খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়েছি পাঁচ বছর হয়ে গেল, তারা একজন রোহিঙ্গাকেও আজ পর্যন্ত ফেরত নেয়নি।”

তিনি বলেন, “আসলেই, আমরা ধৈর্যের সাথে কাজ করছি। আমরা এমন কিছু করি নাই, যার জন্য মিয়ানমারের গোলা এসে আমাদের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে।”

ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “এই কারণে আমরা তাঁদের বলেছি যে, আপনাদের সাহায্য আমরা চাই, যাতে করে মিয়ানমার এ অঞ্চলে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভবিষ্যতে ফায়দা লুটতে না পারে, যাতে এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে না হয়।”

কূটনীতিকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে খুরশেদ আলম বলেন, “মিয়ানমারের উসকানিতে আমরা পা দিচ্ছি না, এটাকে তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে।”

উখিয়া সীমান্তে নতুন করে গোলাগুলি

তুমব্রুর পর মঙ্গলবার মিয়ানমার অংশ থেকে মর্টার শেল ও গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছেন উখিয়া সীমান্তের মানুষ।

গোলাগুলির শব্দে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে বেনারকে জানান পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী।

আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত এলাকার তিন থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমার অংশ থেকে গুলির শব্দ আসছে। দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটে।

গফুর চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকট শব্দে পালংখালী সীমান্তের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।

বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবহিত করার কথা জানিয়ে গফুর জানান, তবে এখনও মিয়ানমারের কোনো গোলা বারুদ বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেনি।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে তলব মিয়ানমারের

সোমবার মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেন সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক উ জাউ ফিউ উইন। বিষয়টি ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে জানিয়েছে মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তলব করার বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন মনজুরুল করিম খান চৌধুরী। তবে তিনি বৈঠকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমার থেকে গোলাবারুদ পড়ার জন্য বিদ্রোহী আরাকান আর্মি এবং জঙ্গি সংগঠন আরসাকে দায়ী করে মহাপরিচালক বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে বলেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের “আন্তরিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে তারা এই কাজ করছে।”

তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মি ও আরসার ঘাঁটি রয়েছে। সেগুলো ধ্বংস করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ পশ্চিমে, দক্ষিণে মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরাকান আর্মি। তাই তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসার কথা না, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এটা না করে।”

চীন বার্তা দিচ্ছে

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, চীন মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মিসহ সেদেশের সকল বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ প্রদান করে বলে অভিযোগ আছে। আবার বাংলাদেশের সাথেও সুসম্পর্ক রেখে চলে চীন এবং রোহিঙ্গা সমস্যা কোনোভাবেই সমাধানের পক্ষে নয় চীন। সেকারণে বাংলাদেশ গত পাঁচ বছর চীনের কাছে ধর্না ধরেছে। এতে কোনো লাভ হয়নি।

মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ বলেন, “সম্প্রতি সীমান্তে মিয়ানমারের উসকানিমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে জাতিসংঘে যাওয়ার যে ঘোষণা সরকার দিয়েছে, তা চীন ভালোভাবে নেয়নি। এই বিষয়টি চীন আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে অনুপস্থিত থেকে বোঝাতে চেয়েছে।”

তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে চীন সহজভাবে বোঝাতে চাচ্ছে যে, তারা বাংলাদেশের সাথে নেই।“

জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাব নেয়া যেতে পারে

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, কোনো দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিংয়ে ডাকলে সেখানে যাওয়া বাধ্যতামূলক। যদি রাষ্ট্রদূত যেতে না পারেন তবে তাঁর প্রতিনিধি পাঠাতে হবে।

তিনি বলেন, “আজকের ব্রিফিংয়ের জন্য দাওয়াত পাওয়ার পরও যদি চীনা দূতাবাসের কেউ না গিয়ে থাকেন সেটি কূটনৈতিকভাবে সঠিক কাজ হয়নি। এটি দুঃখজনক।”

মিয়ানমার থেকে মর্টার ও গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই অবস্থায় বাংলাদেশ দুটি কাজ করতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর বক্তৃতায় মিয়ানমারের এই উসকানিমূলক বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারেন। তখন সারাবিশ্ব মিয়ানমারের বিষয়ে জানতে পারবে।”

শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের এই আন্তর্জাতিক আইনবিরুদ্ধ কাজের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। 

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩১ দিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেদেশের সরকার ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মি সশস্ত্র লড়াই চলছে। এ বিষয়ে কূটনৈতিক প্রতিবাদ করতে ঢাকাস্থ মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে চার বার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হলেও সমাধান মেলেনি।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।