বাংলাদেশ-পাকিস্তান: শীতল সম্পর্ক অবসানের সম্ভাবনা

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.12.11
ঢাকা
বাংলাদেশ-পাকিস্তান: শীতল সম্পর্ক অবসানের সম্ভাবনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একটি ইভেন্টের সাইডলাইনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
[সৌজন্যে: পাকিস্তান হাইকমিশন, ঢাকা]

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান শীতল সম্পর্ক অবসান হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশ দুটি একে অপরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার অবস্থান থেকে সরে এসেছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অবনতিশীল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের কাছে অপ্রিয় পাকিস্তান সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশের কাছে। এই প্রেক্ষাপটে তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আভাস পাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে চলে যায়। অনেকের ধারনা, ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্কের কারণেই পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেয়নি বাংলাদেশ। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামীতে যারা সরকারে আসবেন, তারাও পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক রাখবেন-সেটি ধারনা করা যায়।”

“তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুব বেশি সুবিধা হয়তো হবে না। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চাইবেন না যে পাকিস্তানিরা এখানে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করুক। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তান,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি। দুই দেশের রাজনীতিতে এটি আলোচিত ইস্যু এবং পাকিস্তান সেই গণহত্যার জন্য ভুল স্বীকার করেনি বা ক্ষমা চায়নি।  

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ক্ষতিপূরণ, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদের ভাগাভাগি, আটকেপড়া বিহারিদের পূনর্বাসনসহ অমীমাংসিত অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। এগুলো সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন।”

সম্পর্ক উন্নয়নের আশা দেখাচ্ছে যেসব উদ্যোগে

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনারবাহি একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে, যে সুযোগ আগে ছিল না। আগে পাকিস্তান থেকে আসা কন্টেইনারগুলো শতভাগ পরীক্ষা করা হতো, যা অন্য দেশের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না। এর ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কঠিন হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে অবৈধ অস্ত্রসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ পণ্যের প্রবেশ বন্ধে পাকিস্তান থেকে আসা কন্টেইনারগুলো শতভাগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যাণ্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “গত সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে আসা কন্টেইনারগুলো শতভাগ পরীক্ষা করার যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটি সঠিক ছিল না। কেন কেবলমাত্র পাকিস্তানের জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে?”

এদিকে গত ২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আদেশে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশি ভিসা প্রাপ্তি সহজ করার নির্দেশ দেয়। আগে পাকিস্তানি নাগরিক এবং পাকিস্তান বংশোদ্ভূত উন্নত দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনাপত্তিপত্র লাগত।

এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানের ভিসার চার্জ লাগবে না। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি বিমান যোগাযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর আগস্টে ড. ইউনূসের সাথে সাক্ষাত করেন পাকিস্তান হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ জোরদার করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (দ্বিপাক্ষিক) ড. মো. নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গত সরকারের আমলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে।”

“তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক দৃঢ় করতে দুই দেশকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। পরবর্তী নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবেন বলে মনে করা হচ্ছে সেই দলও ইচ্ছা করলেও ১৯৭১ সালের বিষয়টি বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পারবে কিনা-সেটি বড় প্রশ্ন।”

পাকিস্তান হাই কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল ৬৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

নাসির হোসেন বলেন, “ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাক খাতের জন্য তুলা আনা যেতে পারে। সেখান থেকে গম, ফলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যও আমদানি করা যেতে পারে। এ ছাড়া পাকিস্তানের বাজারে আমাদের পাট, চা এবং ওষুধ রপ্তানি করা যেতে পারে।”

বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে সম্পর্কের উত্থান-পতন

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব (দ্বিপাক্ষিক) সাব্বির আহমেদ রোববার বেনারের কাছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ওঠানামার চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার হলেও পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ভালো হয়। তবে ভারতের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল যেটিকে ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ বলা হয়।

তাঁর মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। তবে পাকিস্তানের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক না থাকলেও স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়ার পর পাকিস্তান আপত্তি জানায়। এরপর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্তের অবনতি হতে থাকে।

রাষ্ট্রদূত সাব্বির আহমেদ বলেন, “এই ঘটনার পর তাদের একজন কূটনীতিককে পারসোনা ননগ্রাটা ঘোষণা করা হয়। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে তারাও আমাদের একজন কূটনীতিককে পারসোনা ননগ্রাটা ঘোষণা করে। এভাবে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এবং গত এক দশকে রাজনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে।”

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শীতল হওয়ায় সার্ক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বলে মনে করেন এই কূটনীতিক।

সাব্বির আহমেদের মতে, “বাংলাদেশের উচিত জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতির আলোক দেশ পরিচালনা করা। একটি দেশের প্রভাবে আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করা উচিত নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।