সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু, সুযোগ পাবে ১০ কোটি মানুষ

রিয়াদ হোসেন
2023.08.17
ঢাকা
সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু, সুযোগ পাবে ১০ কোটি মানুষ গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকায় সন্তানকে কাছে বসিয়ে ইটভাঙার কাজ করছেন এক নারী দিনমজুর। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচির আওতায় এমন স্বল্প আয়ের মানুষজনও সুবিধা পাবেন। ২৫ মে ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পেনশন সুবিধা চালু করেছে সরকার।

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা পেনশন স্কিম চালু করেছি, যাতে দেশের মানুষের জীবন অন্তত অর্থবহ হয়।”

“আগামী দিনেও আমার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অব্যাহত রাখার জন্য আমি বাংলাদেশের জনগণকে অনুরোধ করছি,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই তাড়াহুড়া করে এই কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। এই কর্মসূচি পরিচালনার জন্য এখনো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই।

অর্থনীতিবিদ ও সরকারি নীতি বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “এই সময়ে এটি (সার্বজনীন পেনশন) চালু করা হয়েছে মূলত নির্বাচনকে মাথায় রেখে। এটা পরিচালনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বা আর্থিক দিক থেকে এখনো প্রস্তুত নয় সরকার।”

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরও বলেন, “এটি তাড়াহুড়ো করেই করা হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে নির্বাচনে জনতুষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রেখে করা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”

২০১৭ সালে প্রথম সবার জন্য পেনশনের ধারণাটি সামনে এনেছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিষয়টি নিয়ে তখন আলোচনা হলেও পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সাল থেকে এটি আবার গতি পায় এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘সর্বজনীন পেনশন আইন’ পাস করে সরকার।

ইতোমধ্যে আইনের বিধি প্রকাশ করা হয়েছে এবং পেনশন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে, যার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খান।

বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা তাঁদের চাকরির ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর অবসরে গেলে নির্দিষ্ট সময় পর পর পেনশন পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্নজনকে ভাতা দিচ্ছে।

চারটি স্কিমের তিনটি সরকারের আর্থিক সহায়তার বাইরে

বিধিমালা অনুযায়ী, চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে পেনশনের জন্য। এগুলো হলো—প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য প্রবাস স্কিম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি, স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা ও স্বকর্মে নিয়োজিত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সমতা স্কিম।

এর মধ্যে সুরক্ষা স্কিমের আওতায় থাকবেন কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী। সমতা স্কিমের আওতায় থাকবেন দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২ অনুসারে, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখের সামান্য বেশি, যার মধ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছেন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষদের এক অংশ সরকারের বিভিন্ন ভাতার আওতায় রয়েছেন। তবে ভাতাভোগীরা তাঁদের ভাতার কার্ড সমর্পণ করে পেনশনের তালিকায় যুক্ত হতে পারবেন। তাঁরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে জমা দেবেন, সরকারও সমপরিমাণ অর্থ দেবে।

বাকি তিনটি স্কিমের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য সরকার কোনো টাকা ব্যয় করবে না।

বিধিমালা অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত পেনশনের চাঁদা দেওয়া যাবে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৪২ বছর পর্যন্ত চাঁদা দেবেন। তবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা এ সুবিধার আওতায় আসবেন।

আওতায় আসবে ১০ কোটি মানুষ

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বেনারকে বলেন, “প্রায় ১০ কোটি মানুষ এই পেনশনের আওতায় আসবেন।”

তিনি জানান, বর্তমানে সরকারি, আধাসরকারি ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন ১৮ লাখের মতো মানুষ। এর বাইরে সোয়া এক কোটি মানুষ সরকারের সামাজিক সুরক্ষা সুবিধার আওতায় আছেন।

সরকার অফিস পরিচালনা ও সমতা স্কিমের প্রতি ব্যক্তির জন্য ৫০০ টাকা বাদে আর কোনো ব্যয় করার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রাক্কলিত ব্যয় কত—প্রশ্ন করা হলে কবিরুল ইজদানী খান বলেন, “কত জন আসবে তা তো আমরা এখনো জানি না। এ জন্য সরকারের ব্যয় কত হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।”

তবে এই অর্থ সরকার বিনিয়োগ করবে বলে জানান তিনি।

প্রস্তুতিতে ঘাটতি

সরকার নির্বাচনের আগে এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন শুরু করলেও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “এখনো অনেক কাজ বাকি। এটার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান, জনবল কিংবা বাজেট বরাদ্দ হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পেনশনের আওতায় কারা আসবেন, তাঁদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য উপায় কী হবে? জাতীয় তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে অন্যান্য নতুন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় কিংবা সুদের হার কেমন হবে; এ ধরনের অনেক কাজ এখনো হয়নি।”

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এখনো অফিস, জনবল কিংবা অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়নি। অনেক কাজ বাকি।”

মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ?

বিধিমালা অনুযায়ী, প্রগতি স্কিমের আওতায় কেউ মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ১০ বছর টাকা জমা দেন, তিনি ১০ বছর বা তাঁর বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর পাবেন মাসে সাত হাজার ৬৫১ টাকা। মূল্যস্ফীতি হিসাব করে এই টাকা কতটুকু উপকারে আসবে, তা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ মানুষ।

রাজধানীর একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে চাকরি করেন শামসুল ইসলাম। তিনি বেনারকে বলেন, “আজকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ১০ বছর পরে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে তো ওই বয়সে আমার  ওষুধের খরচও হবে না।”

এই প্রতিবেদক চার জন বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের মধ্যে তিন জনেরই এ বিষয়ে তেমন ধারণা নেই বলে জানান।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এখনকার তিন হাজার টাকা ১০ বছরের পরের সাড়ে চার হাজার টাকা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কতটুকু সাযুজ্যপূর্ণ হবে, সে প্রশ্ন রয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।