সর্বজনীন পেনশন কার্যকরের দিন অচল সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বেনারনিউজ স্টাফ
2024.07.01
ঢাকা
সর্বজনীন পেনশন কার্যকরের দিন অচল সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বজনীন পেনশন স্কিম 'প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনেও বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সামনে থেকে তোলা। ০১ জুলাই ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

আপত্তি উপেক্ষা করে সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ কার্যকর করার প্রতিবাদে সোমবার থেকে দেশের সব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।

এর ফলে সোমবার থেকে দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন বিভিন্ন স্তরের দেশি-বিদেশি ৪৪ লাখ উচ্চশিক্ষার্থী।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৩টি। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থে চালু থাকা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রয়েছেন ১৬ হাজারের কিছু বেশি, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, ‘প্রত্যয়’ চালু হলে একজন অধ্যাপক অবসরের পর কমপক্ষে এক কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন এবং এর ফলে ভালো শিক্ষার্থীরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ হারাবেন যা দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

“আমাদের মানববন্ধন করার কথা নয়”

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রত্যয় পেনশন স্কিম আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সরকারকে তিন মাস ধরে বলে আসছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যেখানে পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে সেখানে এটি কার্যকর না করতে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কথার গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেকারণে আমরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করছি।” 

তিনি বলেন, “আমাদের ক্লাসে থাকার কথা। আমাদের তো সংবাদ সম্মেলন বা মানববন্ধন করার কথা নয়। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের কিছু করারও নেই।”

নিজামুল হক বলেন, “দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব ধরনের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা, কারণ তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

তিনি আরও বলেন, “সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি, এটি দুঃখজনক।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা বেতন স্কেল করারও দাবি জানান তিনি।

অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আরাফাত হোসেন ভূঁইয়া সোমবার বেনারকে বলেন, “আমার প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় সিমেস্টার কখন হবে সেটি এখন বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই আন্দোলন সহসা শেষ হবে না। ”

যেসব শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন তাঁরাও অনিশ্চয়তা পড়েছেন জানিয়ে আরাফাত বলেন, “১ জুলাই থেকে নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর হওয়ার কথা ছিল। ক্লাস কখন শুরু হবে, সেটি নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছে।”

শিক্ষক ধর্মঘটের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি সমর্থন করি। একইসাথে আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষক-কর্মচারীদের নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করবেন।”

7d1d53cf-73a8-4926-89a2-7c7559eab675.jpg
সর্বজনীন পেনশন স্কিম 'প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালনকালে সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে তোলা। ০১ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ]

প্রত্যয় চালুর প্রক্রিয়া

চলতি বছরের ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ অথবা সমজাতীয় সংস্থায় পেনশন কার্যক্রম ‘প্রত্যয়’ চালু হবে।

স্বায়ত্তশাসিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নতুন এই পেনশন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হবে বলে সরকার জানালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষিত প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী, সকল কর্মচারীদের প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা, যেটা কম হয় সেটা তাঁদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে।

উভয় অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ওই কর্মচারীর হিসাবে জমা করবে এবং এই প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তা–কর্মচারীর পেনশন তহবিল গঠিত হবে। সেই তহবিল থেকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ জমাকৃত অর্থের ভিত্তিতে পেনশন দেবে।

কেন বিরোধিতা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আবু খালেদ মোহাম্মদ খাদেমুল হক বেনারকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী যাঁরা কোনো প্রকার পেনশনের আওতায় নেই, তাঁদের জন্য ‘প্রত্যয়’ একটি ভালো স্কিম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী যাঁরা বর্তমানে পেনশনের আওতায় রয়েছেন তাঁদের জন্য এটা ভালো নয়।”

তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক কমপক্ষে ২৫ বছর চাকরি শেষে অবসরে গেলে দুই বছরের গ্র্যাচুয়িটি (আনুতোষিক) পাওয়ার যোগ্য হন। অর্থাৎ তিনি অবসরকালীন মূল বেতনের সমান টাকার ২৪ গুণ টাকা পেয়ে থাকেন যা কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা।

অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, এখন সব শিক্ষক-কর্মচারীর মাসিক বেতন থেকে শতকরা ১০ ভাগ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডে (ভবিষ্য তহবিল) কেটে রাখা হয় এবং এই টাকার বিপরীতে শতকরা ১৩ ভাগ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেওয়া হয়। অবসরের সময় প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ২৫ লাখ টাকার মতো হয়।

“এছাড়া অবসরকালীন সময়ে ওই শিক্ষক তাঁর চাকুরি জীবনে সর্বোচ্চ ১৮ মাস যে অর্জিত ছুটি পেয়ে থাকেন, সেটি নগদায়ন করতে পারেন,” যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “সব কিছু হিসাব করে দেখা যায় সর্বোচ্চ স্কেল পাওয়া একজন অধ্যাপক অবসরের পর গড়ে এক কোটি ১৪ লাখ টাকা নগদ পেয়ে থাকেন। এই টাকা দিয়ে অধিকাংশ শিক্ষকই বাড়ি নির্মাণ করে থাকেন অথবা ফ্ল্যাট কিনে থাকেন। অথবা সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোনো বিনিয়োগ করে শেষ সময়ে আর্থিক সুরক্ষা পেয়ে থাকেন।”

তিনি আরো বলেন, “এই নগদ টাকা পাওয়ার পরও তিনি প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পেনশন পান। তিনি মারা গেলে তাঁর জীবনসঙ্গী আমৃত্যু পেনশন ভোগ করেন। আর সন্তানদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত পেনশন সুবিধা থাকে। কিন্তু প্রত্যয় চালু হলে জীবনসঙ্গী তার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবেন। অর্থাৎ উনি যদি ৬৭ বছর বয়সে মারা যান তাহলে উনার স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা ছেলেমেয়ে পরবর্তী আট বছর সেই পেনশন পাবেন।”

অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “প্রত্যয় চালু হলে শুধু পেনশন ছাড়া যে এক কোটি টাকা শিক্ষকরা পেয়ে থাকেন, সেগুলো আর পাবেন না।”

শিক্ষকদের এই আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

‘প্রত্যয়’ সবার জন্য ভালো: অর্থ প্রতিমন্ত্রী

এদিকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সোমবার বেনারকে বলেন, নতুন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ সবার জন্য ভালো।

তিনি বলেন, “বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় যা দীর্ঘমেয়াদে কোনোক্রমেই টেকসই ব্যবস্থা নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে এ ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, নতুন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ওয়াসিকা আয়শা বলেন, “বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পেয়ে থাকেন। তার অবর্তমানে পেনশনারের জীবনসঙ্গী এবং প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পেয়ে থাকেন। নতুন পেনশন ব্যবস্থাও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। তাঁর অবর্তমানে জীবনসঙ্গী অথবা মনোনীত ব্যক্তি পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন।”

তিনি বলেন, “নতুন ব্যবস্থায় পেনশনারের জীবনসঙ্গীও তাঁর জন্য প্রযোজ্য স্কিমে অংশগ্রহণ করে আজীবন পেনশন পেতে পারেন। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশন ব্যবস্থার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি না করলে সেই সুযোগ নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।