কেন সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিলেন শেখ হাসিনা?
2023.02.13
ঢাকা
বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি কে হতে পারেন—বিভিন্ন মহলে সেই আলোচনায় উঠে আসা নামগুলো বাইরে সম্পূর্ণ নতুন মুখ মো. সাহাবুদ্দিনকে প্রার্থী মনোনীত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় সোমবার তাঁকেই নির্বাচিত ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
পর পর দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পরে কে বঙ্গভবনে যাচ্ছেন তা নিয়ে নজিরবিহীন গোপনীয়তা রক্ষা করেছে আওয়ামী লীগ। দলের কোনো পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম নিয়ে আলোচনা শোনা যায়নি।
সংসদীয় দলের সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনোনয়ন করতে সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিতে একমত হয়েছেন। তিনি যাঁকে যোগ্য মনে করবেন, তাঁকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
আবদুল হামিদের মেয়াদ চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল শেষ হবে। পরের দিন থেকেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করবেন মো. সাহাবুদ্দিন।
পেশাজীবনে প্রবেশের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন সাহাবুদ্দিন। পরবর্তীতে তিনি বিচার বিভাগে যোগ দিয়ে জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন। অবসরের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
দলের নেতাদের ভাষ্য, সাহাবুদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, দল ও শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্যে প্রশ্নাতীত। সেই কারণে হয়তো তাঁকে বেছে নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করার খবর ছড়িয়ে পড়লে পাবনা শহরে আনন্দ মিছিল বের করেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।
তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পদে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই, সাবেক চিফ হুইপ ও বর্তমানে বরিশালের আগৈলঝরা আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ সোমবার বেনারকে বলেন, “যিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন উনি আমাদের দলের লোক। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”
তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জানি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উনার পারিবারিক যোগাযোগ ছিল।”
পাবনা জেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক কর্মী এবং চিকিৎসক ড. রাম দুলাল ভৌমিক সোমবার বেনারকে বলেন, “চুপ্পু সাহেব একজন নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পরে উনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন।”
প্রসঙ্গত, ঘনিষ্ঠজনেরা সাহাবুদ্দিনকে তাঁর ডাকনাম ‘চুপ্পু’ হিসেবেই উল্লেখ করে থাকেন।
সাহাবুদ্দিন আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে একটি বড়ো সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরিচালকের পদে ছিলেন এবং সেখান থেকে জেলা দায়রা জজের পদে থেকে অবসর গ্রহণ করেন বলেও জানান রাম দুলাল ভৌমিক।
“বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর উনি তিন বছর জেল খেটেছেন” জানিয়ে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর আনুগত্যের কোনো ঘাটতি নেই।”
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যখন দুর্নীতির অভিযোগ এলো, তখন তিনি (সাহাবুদ্দিন) দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার। ওই সময় তিনি খুব বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করেন।”
“পরবর্তীতে কানাডার আদালতে রায় আসে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো প্রকার দুর্নীতির চেষ্টা হয়নি। এটি হয়তো তাঁকে মনোনীত করার একটি বড় কারণ হতে পারে,” বলেন রাম দুলাল ভৌমিক।
মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “একজন তৃণমূল রাজনীতিককে দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন করেছেন, যেটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়,” বলে মন্তব্য করেন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের হুইপ ইকবালুর রহিম।
সোমবার তিনি বেনারকে বলেন, “উনি মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সেহেতু রাষ্ট্রপতি পদে উনার আসীন হওয়াটা রাজনীতির জন্য শুভ বলে আমি মনে করি।”
আগ্রহ নেই বিএনপি’র
প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই।
বিএনপি’র মিডিয়া সেলের সদস্য এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি সোমবার বেনারকে বলেন, “এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।”
দলীয় আগ্রহ কেন নেই ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার কথা সংসদ সদস্যদের ভোটে। কিন্তু আমরা দেখেছি কীভাবে ভোট জালিয়াতি করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। যেখানে এমপি সাহেবরাই জালিয়াতি করে নির্বাচিত, সেখানে উনারা কাকে নির্বাচিত করছেন-না করছেন সে ব্যাপারে দেশের মানুষের কোনো আগ্রহ নেই।”
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতির কথা বললেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
আনুগত্যই প্রধান যোগ্যতা?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ সোমবার বেনারকে বলেন, “মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করার কারণ হলো দলের প্রতি উনার আনুগত্য। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা একজন অনুগত মানুষকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে খুঁজছিলেন।”
তিনি বলেন, “আমাদের ব্যবস্থায় একজন প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ অনুগত রাষ্ট্রপতি দরকার। এর কারণ হলো, রাষ্ট্রপতির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা না থাকলেও উনার একটি সরকারবিরোধী বক্তব্য সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য যথেষ্ট।”
অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আরও বলেন, “১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে সাহাবুদ্দিন আহমদের সমালোচনা করে দেওয়া বক্তব্যে সরকার বিপদে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।”
“অনুগত রাষ্ট্রপতি খোঁজার আরেকটি কারণ হলো, যদি আগামী দিনগুলোতে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভীষণভাবে রাষ্ট্রপতিকে দরকার হবে। প্রয়োজন হলে রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি।”
তিনি বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় এই রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেটি গণতান্ত্রিক হয়নি। দলের সংসদীয় দলের সভায় আলোচনার পরিবর্তে সাধারণ সম্পাদক বললেন যে, আমরা প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের ক্ষমতা দিলাম। উনি যাঁকে মনোনীত করবেন, দলের সবাই তাঁকে সমর্থন করবেন। আর সবাই সেটিকে সমর্থন করলেন। এটি কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। রাষ্ট্রপতি পদে উনার নিয়োগ নিয়ে আলোচনা করে পাস করিয়ে নিলে প্রক্রিয়া কিছুটা গণতান্ত্রিক হতো।”
“সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ দিলেন রাষ্ট্রপতিকে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন।