রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ, আইনমন্ত্রীর নাকচ
2023.02.14
ঢাকা
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আইন মেনে তিনি এই পদে যেতে পারেন কিনা এবং রাষ্ট্রপতি পদটি ‘লাভজনক’ কি না তা নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাঁর নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং আইনজীবীদের একটি অংশ বলছেন, রাষ্ট্রপতি পদটি রাষ্ট্রের লাভজনক পদগুলোর একটি এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করার মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন লঙ্ঘিত হয়েছে।
দুদক আইন অনুযায়ী, কমিশনের একজন কমিশনার অবসর নেওয়ার পর রাষ্ট্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না।
অপরপক্ষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও নির্বাচন কমিশনের মতে, রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক পদ নয়, ফলে এটি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক কি না তা নিয়ে ১৯৯৬ সালের পর এই দ্বিতীয়বারের মতো বিতর্ক সৃষ্টি হলো।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেবার পর হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এতে অভিযোগ করা হয়েছিল প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেবার পর কেউ রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারেন না।
ওই রিটের শুনানি শেষে রাষ্ট্রপতি পদটি ‘লাভজনক নয়’ বলে রায় দিয়েছিল আদালত।
রাষ্ট্রপতি পদ ‘লাভজনক’ কি না
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের মতে “সোজা কথায় রাষ্ট্রের লাভজনক পদ সেটি, যার বিপরীতে নিয়োজিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য আর্থিক ও বিভিন্ন বৈধ সুবিধা নিয়ে থাকেন। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি পদটি একটি লাভজনক পদ।”
মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর নয় ধারা অনুযায়ী, একজন কমিশনার অবসরের পর রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য থাকবেন না। আমাদের নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ছিলেন। আমার বিবেচনায় তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারেন না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া “দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের লঙ্ঘন।”
“আমার মতে উনার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের আইন লঙ্ঘিত হয়েছে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন বদিউল আলম মজুমদার।
এছাড়া মো. সাহাবুদ্দিনের নিয়োগের সাথে “আরেকটি নৈতিক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “উনি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। উনি যখন পরিষদে ছিলেন সেই সময়ে ইসলামী ব্যাংকে বড়ো আর্থিক অনিয়ম সংগঠিত হয়। পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য হিসাবে উনি কি এর দায় এড়াতে পারেন?”
তবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হকের মতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত কমিশনার রাষ্ট্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না, এটি সত্য হলেও মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে “সেটি প্রযোজ্য নয়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “সংবিধানের ৬৬ ধারার তিন উপ-ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য পদ লাভজনক নয়।”
“আমাদের নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হননি,” জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। সেখানেই বলা আছে, রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক পদ নয়। সুতরাং, অন্য আইনে যা বলা থাকুক না কেন সংবিধানের বিধানই প্রথম ও শেষ কথা।”
তিনি বলেন, “এগুলো নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।”
ইসলামী ব্যাংকের ঋণের অনিয়মের সাথে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির দায় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, “উনি পরিচালনা পরিষদের সদস্য থাকা অবস্থায় কী ভূমিকা ছিল সে ব্যাপারে না জেনে অহেতুক প্রশ্ন উত্থাপন করা ঠিক নয়।”
তবে সংবিধানের ৬৬(৩) ধারার ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক বলেন, “ওই ধারাটি সংসদ-সদস্য পদে নির্বাচনের ব্যাপারে বলা আছে। ওই ধারার স্পিরিট অনুযায়ীই রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক পদ।”
এ ব্যাপারে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “লাভজনক পদের ব্যাপারে সংবিধানে বিপরীতমুখী বিধান রয়েছে। একটি ধারায় বলা হচ্ছে, লাভজনক পদ। আরেক ধারায় বলা হচ্ছে লাভজনক নয়।”
এদিকে মো. সাহাবুদ্দিন “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছেন,” মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ-সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “উনি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রপতি। আমাদের সবার উচিত উনাকে বিতর্কের বাইরে রাখা।”
নির্বাচন কমিশন সোমবার দুদকের সাবেক কমিশনার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী ঘোষণা করে। এই নির্বাচনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন রোববারই রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মো. সাহাবুদ্দিনের নাম ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
আগামী ২৪ এপ্রিল বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।