ভোটার তালিকা প্রকাশ, তবে ভোটাধিকার নিয়ে শঙ্কা
2023.03.02
ঢাকা
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষের অনড় অবস্থানের মধ্যে বৃহস্পতিবার ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন।
প্রকাশিত ওই তালিকা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯১ লাখের কিছু বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার। গত বছর মার্চে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি ৩৩ লাখ।
এদিকে ভোটার তালিকা প্রকাশের দিনেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের এক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
এ বছর শেষে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বৃহস্পতিবার ভোটার তালিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, “বিএনপির প্রতি আমরা বারবার আবেদন জানাচ্ছি আপনারা আসুন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। আপনাদের মধ্যে যদি মত-পার্থক্য থাকে, সেটা আপনারা নিরসন করার চেষ্টা করুন। কারণ নির্বাচন কমিশন মুরুব্বিয়ানা করতে পারবে না।”
তাঁর এই মন্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা শুধু নির্বাচন আয়োজন করবে। তাদের এই কথায় বোঝা যাচ্ছে, তারা সরকারের দেখানো পথ ধরেই হাঁটছে।”
“আর এমনটি হলে দেশে আরও একটি একতরফা নির্বাচনের হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে দেশের ভয়াবহ ক্ষতি হবে,” বলেন ড. বদিউল আলম।
তাঁর মতে, “২০১৪ সালের একতরফা সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ধারাবাহিকভাবে জালিয়াতির কারণে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই।”
“আবার একতরফা নির্বাচন হলে মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারবে না,” বলেন তিনি।
কঠোর অবস্থানে দুই দল
এদিকে “যতক্ষণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার না আসছে এবং তার অধীনে নির্বাচন না হচ্ছে ততক্ষণ কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না,” বলে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক আলোচনা সভায় মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত জোটকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে নির্বাচন করে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“আমাদের দলের মূল অবস্থান হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করা,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন।
আওয়ামী লীগ “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে পরপর দুইবার ক্ষমতায় এসেছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।”
“বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না,” বলেন জহির উদ্দিন স্বপন।
তবে আওয়ামী লীগের মতে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই এবং তা সংযোজনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
“বাংলাদেশে আর কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে না,” বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান।
“বর্তমান সংবিধানের আলোকেই বর্তমান সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, সেই নির্বাচনে “বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটি তাদের বিষয়।”
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদারের ধারণা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়ত বিএনপি অংশগ্রহণ করবে।
“২০১৪ সালের পর থেকে পর পর দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনগণ এবং প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতৃত্বে গঠিত জোটের অভিযোগ রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে “একটি সমঝোতা হয়ে যাবে।”
“পরপর তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সহ্য করা কঠিন। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্যই দুই দলকে সমঝোতায় আসতে হবে,” বলেন তিনি।
নির্বাচন বয়কটের সংস্কৃতি
সামরিক শাসক লে. জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন বয়কটের সংস্কৃতি রয়েছে।
১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ওই নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে।
রাজনৈতিক মত পার্থক্য ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ।
দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে। সেই ভোটে জাতীয় পার্টি সরকার গঠন করে এবং জাসদের একাংশ আ স ম আব্দুর রবের দল সম্মিলিত বিরোধী দল হিসাবে সংসদে আবির্ভূত হয়।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি পূরণ না হওয়ায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বাংলাদেশের সকল দল। একতরফা ভোটে ক্ষমতায় আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতাকারী দল বিএনপি।
আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পদত্যাগ করে বিএনপি সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়। এই সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার প্রতিবাদে তখন মাঠে নামে বিএনপি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি এবং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় দলটি।
সহিংসতা ও আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা।
দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নেয় বিএনপি। তবে দলটির অভিযোগ ভোটের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বাকশো ভরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
তবে আওয়ামী লীগ বরাবর এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।